২০২০ সালটা যেন শুভ হয়

সম্পাদকীয়
নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে গেল ২০১৯। আবির্ভূত হলো নতুন বছর ২০২০। ইংরেজি নববর্ষকে আমরা জানাই স্বাগত। মানুষ তো আশায় ঘর বাঁধে, তাই আমরাও নতুন বছরে আশাবাদী হতে চাই। ব্যর্থতার গ্লানিকে পেছনে ফেলে নতুন অভিযাত্রায় মগ্ন হতে চাই। তবে আশাবাদের ভিত্তি থাকা প্রয়োজন।

এই ভিত্তি তৈরি করতে গেলে বিগত বছরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যর্থতার যে কারণগুলো লক্ষ্য করা গেছে তার প্রতিকার প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পৃথিবীর নাগরিক হলেও আমরা দাঁড়িয়ে আছি স্বদেশের ভূমিতে। স্বদেশেই আমাদের জীবনযাপন। উন্নয়ন ও প্রগতির কর্মধারায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলে পৃথিবী পরিচালনায়ও আমরা অবদান রাখতে সক্ষম হবো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সুশাসনের অভাবে জাতীয় সংহতি ও প্রগতির বদলে আমরা ক্রমান্বয়েই হিংসা-বিদ্বেষ, দমন-অবদমন ও অর্থহীন রাজনীতির গভীর পাঁকে জড়িয়ে যাচ্ছি। ২০১৯ সালটাও যেন এই পাঁকের মধ্যেই ডুবেছিল। ফলে শুধু আশাবাদের কারণে ২০২০ সালটা আমাদের জন্য কাক্সিক্ষত জীবন-যাপনের বছর হিসেবে পরিণত হবে না। কাক্সিক্ষত জীবন ও সমাজের জন্য প্রয়োজন হবে বিগত বছরের ভুলত্রুটি উপলব্ধি করে সংশোধনের সঙ্গত পথে চলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে ২০২০ সালটা আমাদের জন্য আশাবাদের বছর হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে।

নতুন বছরের পাটাতনে দাঁড়িয়ে যদি পেছনের দিকে তাকাই তাহলে বিস্মিত হতে হয়। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরেও আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন পদ্ধতির ব্যাপারে একমত হতে পারলাম না! বিগত বছরে আমরা যে অস্বস্তিকর পরিবেশে জীবনযাপন করতে বাধ্য হলাম, তার প্রধান কারণ কিন্তু সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন পদ্ধতির অভাব। নতুন বছরে এ ক্ষেত্রে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারলে আমরা হয়তো কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে চলতে সমর্থ হবো। বিগত বছরে আমরা সুশাসনের সঙ্কট লক্ষ্য করেছি, লক্ষ্য করেছি একদলীয় শাসনের প্রতাপও। ফলে শাসকদলের সুবিধাভোগীরা ছাড়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তিত-বিরক্ত হয়ে উঠেছে। তাই নতুন বছরে আশাবাদী হওয়ার জন্য একদলীয় শাসনের পরিবর্তে সুশাসনই জনগণের কাম্য। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কোনো বোধোদয় ঘটে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। বিগত সময়ে নির্বাচন নিয়ে যে ছলচাতুরী ও প্রহসনের রাজনীতি লক্ষ্য করা গেছে, নতুন বছরের শুরুতেই তাতে গুণগত পরিবর্তন প্রয়োজন। জনগণ যদি দেশের প্রকৃত মালিক হয়ে থাকে, তাহলে গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে নির্দলীয় তথা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে নতুন বছরে যদি আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রসম্মত সুবিবেচনার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে নতুন বছরে আমাদের দুঃখের মাত্রা আরো বেড়ে যেতে পারে। এখন দেখার বিষয় হলো, সংশ্লিষ্টরা নতুন বছরে তাদের আচরণের মাধ্যমে কোনো আশাবাদের সঞ্চার করতে সক্ষম হন কিনা।

স্বদেশের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিগত বছরটি তেমন সুখকর ছিল না। মিয়ানমারে আমরা মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হত্যা, ধর্ষণ ও জাতিগত নিপীড়ন লক্ষ্য করেছি। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনের ঘটনা প্রবাহ আমাদের মধ্যে হতাশার মাত্রাই বাড়িয়েছে। বিগত বছরেও জাতিসংঘসহ বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা ছিল প্রশ্নবোধক। আমরা জানি, মধ্যপ্রাচ্যের সংকট বর্তমান বিশ্বে অশান্তির একটি বড় কারণ। কিন্তু এ সংকট সমাধানে আমরা গত বছরও আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করিনি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিম দেশ ও মুসলমানদের স্বার্থগুলো সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সবার সংকটের সমাধান হয় কিন্তু মুসলমানদের সংকট আবর্তিত হতে থাকে। এখানে সমাধান যেন থমকে যায়। ফলে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা কোটি কোটি মুসলমানের কাছে এক প্রশ্নবোধক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বাস্তবতা থেকে মুসলমানদের শিক্ষা নেয়ার মতো বিষয় রয়েছে। মুসলমানরা যদি ঐক্য-সংহতির চেতনায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে বলীয়ান হয়ে নিজেদের সম্পদকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়, তাহলে শুধু যে নিজেদের ভাগ্যেরই পরিবর্তন হবে তা নয়, বিশ্ব সভ্যতায় অবদান রাখার মাধ্যমে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতেও সক্ষম হবে। নতুন বছরে এ সত্যটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হলে মঙ্গল।