স্রষ্টার অবাধ্যতার পরিণাম

হযরত নুহ (আ:) কওমের সরদারের কথোপকথোনে সুস্পষ্ট এটাই প্রমাণ হয় যে নবী যতই আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে সতর্কমূলক কথা, ঈমান আনার কথা, কোনটাতেই রাজী নয়। আল্লাহ পাকের নির্দেশনা কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তাদের ভোগ বিলাস আর বাপ দাদাদের শিরকযুক্ত অসামাজিক উশৃংঙ্খলতা দুনিয়ার বিপর্যয়ের দ্বারা কে অব্যাহত রাখতে চায়। এমন কি এর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন আযাব আসে তাতে তাদের কোন পরোয়া নেই। নবী স্বজাতির এমন মনোবেদনা ও দুঃখ নিয়ে তার কওম কে আহবান জানিয়ে বলেন, “আর আমি তোমাদের নসিহত করতে চাইলেও তো তোমাদের জন্য তা ফলপ্রসূ হবে না। যদি আল্লাহ তোমাদের গোমরাহ করতে চান অথচ তিনি তোমাদের পালনকর্তা এবং তার কাছে তোমাদের ফিরে যেতে হবে।” (সুরা হুদ ৩৪ আয়াত)। এরপর নাফরমান জাতি রসিকতা করে বলল,হে নুহ তুমি কোরআনের কথা বলছ তুমি নিজেই এটাই বানিয়ে বাহানা করছ” অত:পর আল্লাহপাক স্পষ্ট করে বলেন,“হে নবী তারা কি বলে কোরআন রচনা করে এনেছেন?আপনি বলে দিন আমি কোরআন রচনা করে এনে থাকি সে অপরাধ আমার আর তোমরা যে অপরাধ করছ তার সাথে আমার কোন সর্ম্পক নেই। (সুরা হুদ ৩৫ নং আয়াত)।
অতঃপর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত নুহ (আ:)-এর নাফরমান ও র্তাকিক কওমের জন্য আযাব নির্ধারিত হয়ে গেল।এবং তাদের উপর আসমান থেকে প্রবল বেগে বর্ষণ শুরু হলো, জমিন ভেদ করে পানির ফোয়ারা উৎক্ষিপ্ত হয়ে নাফরমান জাতির সমগ্র এলাকাকে ডুবিয়ে দিল। তথা কথিত অস্বীকারকারী বিজ্ঞ জালিম জাতির সলিল সমাধি রচিত হল। অপর পক্ষে আল্লাহ পাক তার প্রিয় নবী ও অনুগতকারীদের কুদরতি ক্ষমতা বলে বাঁচিয়ে দিলেন। এ সর্ম্পকে আল কোরআনের ভাষ্য,আর আপনি আমার সস্মুখে আমার নির্দেশ মতো একখানা নৌকা তৈরী করুনএবং পাপিষ্টদের ব্যাপারে আমাকে কোন কথা বলবেন না। আবশ্যই তারা ডুবে মরবে” (সুরা হুদ ৩৭ নং আয়াত)।
অত:পর আমি মুসলধারে বর্ষণের সাথে আসমানের দুয়ার সমুহ খুলে দিলামএবং যমীনে প্রস্রবণ রুপে প্রবহমান করলাম (সুরা আল কামার ১১ নং আয়াত। এভাবে নাফরমান কওম ধ্বংস প্রাপ্ত হলো।
মহান আল্লাহ তার সৃষ্টি পরম্পরায় ঐতিহাসিক “আদ” জাতির কাছে তার বাণী বাহক নবী হযরত হুদ (আ:) কে প্রেরণ করলেন। হযরত হুদ (আ:) জাতির নাম ছিল আদ জাতি। নবী তার সম্প্রদায়ের কাছে এ আহবান জানালেন যে,“ হে আমার কওম তোমার পালন কর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করো এবং তার প্রতি মনো নিবেশ করো। তিনি তোমাদের প্রতি বৃষ্টিধারা বর্ষণ করবেন। তোমাদের ওপর আরো শক্তি বৃদ্ধি করে দেবেন। তোমরা অপরাধিদের মতো বিমুখ হয়ো না। (সুরা হুদ আয়াত ৫২)
প্রতি উত্তরে তারা বললেন “ হে হুদ তুমি আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নিয়ে আসো নাই।আমরা হযরত হুদ (আ:)। তোমাদের মেকি কথায় দেব দেবীদের বর্জন করতে পারি না।আর আমরা তোমার প্রতি ইমান আনয়নকারী নই।
এরং আমরা বলি আমাদের কোন দেবতা তোমাদের কাধেঁর ওপর শোচনীয়ভাবে আসর করে বসেছে। (সুরা হুদ ৫৩ ও ৫৪ নং আয়াত) আদ জাতির কথার বাচন ভঙ্গিতে তারা এটাই প্রকাশ করতে চেয়েছে যে,তারা তাদের জ্ঞাতি ভাই হুদ (আ:) এর চেয়ে জ্ঞানী আর পন্ডিত। তার সম্প্রদায় কোন কথায় তারা কর্ণপাত করল না। আর তারা নিজেদের হটকারিতা ও অবাধ্যতার ওপর অটল রহিল।
অবশেষে প্রচন্ড ঝড় তুফান আল্লাহর আযাব নেমে এলা। সাত আট দিন ঝড় তুফানে তাদের ঘরবাড়ী ধ্বসে গেল। গৃহাদি উড়েগেল গাছপালা ফসলাদি উজাড় হলো। মানুষ ও জীব জন্তু শুণ্যে উত্থিত হয়ে সজোরে জমিনে নিক্ষিপ্ত হলো।আর কোরআন বলছে, “ভয়ংকর গর্জনের মাধ্যমে তাদের কে হত চকিত করে ব্যাত্যাতাড়িত আবর্জনা সদৃশ করে ছিলেন। (সুরা মুমিনুন ৪১ নং আয়াত)। এভাবে মানবদেহের অধিকারী শক্তিশালি একটি জাতি দুনিয়ার বুক থেকে সম্পূর্ন ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গেল।
এর পর মহান আল্লাহ সামুদ জাতির কাছে হযরত সালেহ (আ:) কে পেশ করলেন। হযরত সালেহ (আ:) তার কওম কে আহবান জানিয়ে বললেন।“ আমি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণী বাহক নবী। তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতিত কোন উপাস্য নেই। আর তোমাদের কাছে আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটি প্রমাণ। আল্লাহর উষ্ট্রী এ চরে বেড়াবে স্বাধীনভাবে এতে তোমরা বাঁধা দিওনা। তাহলে তোমাদের যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে। (সুরা আল আরাফ ৭৩ নং আয়াত)।
অতঃপর তারা গেণ উষ্ট্রী বধ করে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করে এবং বলে, ‘হে সালহ! তুমি রাসূল হলে আমাদেরকে যার ভয় দেখাইতেছ তা আনয়ন কর।’ ৮৭ উদ্ধত জাতি কে পাকড়াও করল ভূমিকম্প ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। (সুরা আরাফের ৭৮ নং আয়াত।)
তারপর মহান আল্লাহ তার এক বাণীবাহক হরত লুত (আ:)কে প্রেরণ করলেন। জর্ডান ও বায়তুল মুকাদ্দাসের মধ্যবর্তি ছাদুমের অধিবাসীদের হেদায়েতের জন্য। এখানে ছাদুম, আমুরা, উবা, ছাবুরিম, কলে অথবা সূগর নামে পাঁচটি বড় বড় শহর ছিল। আল কোরআনে এ জাতি সমষ্টি কে সুতাফেকা শব্দে বর্নণা করা হয়েছে। এসব শহরের মধ্যে ছাদুম ছিল রাজধানি। হযরত লুত (আ:) এখানেই অবস্থান করতেন। এখানের ভূমি ছিল খুব উর্বর ও শষ্য শ্যামল।তাদের সামনে আল্লাহ স্বীয় নিয়ামতের দ্বার খুলে দিয়ে ছিলেন। সেখানকার অধিবাসীরা ধন ঐশ্বর্যের নেশায় মত্ত হয়ে বিলাসবাগণ কাম প্রবৃত্তি এবং লোভ লালসায় জাল এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ে যে, তারা লজ্জা শরম ইজ্জত আব্রুর স্বভাবজাত পার্থক্য থেকে ও বিস্মৃত হয়ে পড়ে।তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাম আসক্তিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ল। তারা পুরুষ কতৃর্ক অন্য পুরুষের সাথে মৈথুন করা, বর্তমানে তা সমকামিতার শামিল।কাজটি ব্যাভিচারের চেয়ে জঘণ্য অপরাধ।এরই কারণে ঐ অভিশপ্ত কওমের উপর এমন আযাব গযব নাজিল হয়ে ছিল যা অতীতে কোন কওমের উপর নাযিল হয়নি।মহান আল্লাহ পাক স্বয়ং এ সর্ম্পকে কোরআনপাকে এরশাদ করেছেন। “আমি লূত কে প্রেরণ করেছি। স্বীয় কওম কে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ যা তোমাদের পূর্বে সারা বিশ্বে কেউ করেনি। তোমরা তো কামবশত পুরুষের কাছে গমন করো নারীদের ছেড়ে বরং তোমরা সীমা অতিক্রম করছ। (সুরা আরাফ ৮০ ও ৮১ নং আয়াত)।
কোরআনে সর্তকবাণী পেশ করার পর তার কওমের লোকেরা আরো ক্ষিপ্ত হলো। যালিম সরকারের বাহিনী কে নির্দেশ দিল কে আছ ! তোমরা এক ও তার অনুগামীদের কে ঘাড় ধরে বের করে এ শহর থেকে বের করে দাও। আমাদের হিতোপদেশ দিয়ে ওরা সাধু স্জাতে চায়। এ প্রসঙ্গে কোরআন বলছে, “তার সম্প্রদায় এছাড়া আর কোন উত্তর দিল না। যে বের করে দাও এদের এ শহর থেকে। এরা খুব সাধু থাকতে চায়। (সুরা আরাফ ৮২ নং আয়াত।)
এখানে স্মরনযোগ্য বর্তমান বিশ্ব আধুনিকতার এবং উন্নয়নের সর্বোচ্চ শিখরে বাস। মানুষ মাটির পৃথিবী ছেড়ে মহাশূণ্যে গ্রহপুঞ্জিতে অবস্থান করছে। ভোগবিলাস আর যান্ত্রিক সভ্যতার জীবণ ধারায় মানুষ অতীতের সকল কিছু ছাড়িয়ে অতি উন্নসিকতার জীবনে তৎপর রয়েছে। ভোগবাদ ও পুঁজিবাদ মানুষের জীবনে এক মাত্র কামনা বাগণায় পরিণত হয়েছে। ফলে পৃথিবীতে এখন প্রতিযোগিতা চলছে। হযরত লুত (আ:)-এর জাতিকে সর্তক করার পর যখন তার উপদেশ গ্রহন করলো না,তখন লুত (আ:) তার আহল সঙ্গী অনুগামীদের নিয়ে ঐস্থান ত্যাগ করল। প্রত্যুষে হযরত জিব্রাঈল (আ:) শিশু বাচ্চারা খেলাচ্ছলে মাটি শূন্যে উড়িয়ে দেয়, ঠিক তেমনি শহর তলীর চারপাশে হাত ঢুকিয়ে জমিনটা উল্টিয়ে ধ্বংস করে দেয়। এ প্রসঙ্গে কোরআন পাকে এরশাদ হয়েছে “অবশেষে যখন আমার হুকুম এস পৌছে গেল তখন আমি উক্ত জনপদ কে উপরি নিচু করে দিলামএবং তার স্তরে স্তরে কাঁকর পাথর নিক্ষেপ করলাম। যার প্রতিটি তোমার পালন কর্তার নিকট চিহ্নিত ছিল। আর গেণ পাপিষ্ঠদের থেকে শাস্তি বেশী দুরে নয়। (সুরা হুদ ৮২ ও ৮৩ নং আয়াত)
এরপর আল্লাহ “মাদাইন” বাসীদের হেদায়েতের জন্য হযরত শুয়াইব (আ:) কে পাঠালেন। এ জাতির বৈশিষ্ঠ্য ছিল তারা ওজনে কম দিতএবং মানুষের হক নষ্ট করত। এছাড়া তারা ব্যবসায়ীদের মালামাল লুণ্ঠন করত। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে মাদাইনবাসীদের লক্ষ্য করে এরশাদ করেন, “তোমরা মাপে ওজনে পূর্ণ কর এবং মানুষদের কে ওজনে কম দিও নাও ভূপৃষ্ঠে সংস্কার সাধন করার পর বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। (সুরা রাদ ৮৫ নং আয়াত)। মাদাইনবাসীদের জুলুম নির্যাতনের ভূপৃষ্ঠে বিপর্যয় সৃষ্টির সীমা অতিক্রম করল তখন মহান আল্লাহ পাক নবী ও বিশ্বাসীীদের মুক্তি দিলেন। অভিশাপি বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের উপর এমন ভূমিকম্প, ঝড়, অগ্নি বৃষ্টি, এনভাবে বর্ষণ করলেন তার জাতিরা সকাল বেলা নিজ নিজ বাসগৃহে মৃত লাশ উপুড় হয়ে পড়ে রহিল।
এরপর বনি ইসরাঈল জাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তার প্রিয় বান্দা হযরত মুছা (আ:)কে পাঠালেন। হযরত মুছা ফেরাউনের উদ্দেশ্য করে জানালেন। “হে ফিরাউন আমি বিশ্ব প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আগত রাসূল।আমি তোমাদের পরোয়ার দিগরের নির্দেশনা নিয়ে এসেছি। সুতারাং তুমি বনি ইসরাীলদের মুক্ত করে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও। (সুরা সুরা আরাফ আয়াত ১২৪) অবশেষে ফেরাউনের নাফরমানির কারণে আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দিলেন।
এভাবে বান্দাহ যখন নাফরমানিতে লিপ্ত হয় তখন আল্লাহ মহামারি, বন্যা, তুফান, অগ্নিবর্ষণ ভূমিকম্প ইত্যাদি দিয়ে সে জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। বর্তমান শতাব্দীতে প্রারাম্ভে নীরব ঘাতক জীবাণু করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ আক্রমণে তার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি বলে মনে করা যেতে পারে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, ঘাতক করোনা বিধ্বংসী জীবাণু যুদ্ধের পর মানবজাতির বসবাস তার গতিপ্রকৃতি কিভাবে নির্ধারিত হতে পারে? নতুন এক পৃথিবীর আলোর পরিস্ফুটন কি সমাসন্ন?
জ্ঞানীদের চিন্তা সঠিক ধারায় প্রবাহিত হলে ভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীতে বর্তমান জাতিসমূহের পরিবর্তে মহান আল্লাহ পাক অন্য কোন সুশীল, সাম্য, ইনসাফ এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কল্যাণকারী জাতি সত্তার আবির্ভাব ঘটাতে পারেন। (সমাপ্ত)
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, গাজী নজরুল ইসলাম email: gazinzrulislam1952@gmail.com