স্বাধীনতার মাস

আজ সোমবার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। একাত্তরের এই দিনে কাকডাকা ভোরের পর্দা সরিয়ে পূর্বাকাশে অরুণোদয় হয়েছিলো ভিন্ন এক বারতা নিয়ে। সে বারতায় ছিলো অনন্য দ্যোতনা, অন্তগুঢ় উচ্ছ¡াস। মুক্তিকামী মানুষের মিলন মোহনায় পরিণত হয়েছিলো ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)।

ঐতিহাসিক এই ময়দান ছিলো লাখো বিক্ষুব্ধ, স্বাধীনতা পিয়াসী জনতার উত্তাল ঊর্মিমুখর। দশদিগন্ত রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাঁপছে। এক অভূতপূর্ব ও অবর্ণনীয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরিবেশে বেলা আড়াইটায় মহান স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণ শুরু করেন। ক্ষোভ উত্তেজনা ও আবেগে আলোড়িত রেসকোর্সের জনসমুদ্রকে মহান নেতার ভাষণ উত্তেজনায় আরো উদ্দীপ্ত করে তোলে।
বঙ্গবন্ধু তার ‘অবিস্মরণীয়’, অনেকের মতে ‘মাস্টারপীস’ বক্তৃতা শুরু করেন দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের বেদনার ভাষা দিয়ে। প্রায় ১৮ মিনিটের ভাষণের শেষাংশ ছিল চাপ প্রয়োগের কর্মসূচি এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ। যা দুর্বিনীত এক পক্ষের কাছে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য ছিলো অপরিহার্য। তিনি সেদিন আবেগের কাছে নয়, বুদ্ধিবৃত্তির কাছে আবেদন রেখেছিলেন, যা সমস্যা সমাধানের জন্য সহায়ক। বঙ্গবন্ধুর ভরাট কণ্ঠে ৭ মার্চের সেই ভাষণ কোনো নতুন সংকট সৃষ্টি করেনি বরং সংকট সমাধানের পথ আরো উন্মুখ করেছিলো।
এদিন বঙ্গবন্ধু সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত অহিংস অসহযোগের নিম্নলিখিত সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তা হলো- ১. কর না দেয়ার আন্দোলন চলবে, ২. সচিবালয়, সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, হাইকোর্ট

এবং বাংলাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে, ৩. রেলওয়ে ও বন্দরসমূহ কাজ চালিয়ে যাবে, ৪. বেতার-টেলিভিশন ও সংবাদপত্রকে আমাদের বক্তব্যের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করতে হবে এবং তারা জনতার আন্দোলনের সংবাদ চেপে যেতে পারবে না, ৫. সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে, ৬. স্টেট ব্যাংক বা অন্য কোনো উপায়ে দেশের পশ্চিম অঞ্চলে টাকা পাঠাতে পারবে না এবং ৭. প্রতিদিন সকল ভবনে কালো পতাকা উড়াতে হবে।
এডভোকেট বদরুদ্দিন আহমদ তার ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য কাহিনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, শেখ মুজিব সেদিনও আলোচনার মাধ্যমে বিরোধের মীমাংসা চেয়েছিলেন। নইলে তিনি অবস্থার প্রেক্ষিতে রেডিও মারফত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারতেন।

রেডিও স্টেশনসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনযন্ত্র তখন শেখ মুজিবের নিয়ন্ত্রণে গণপরিষদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে আওয়ামী লীগের অনেক সুবিধা ছিলো। স্বাধীনতা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে স্বীকৃতিও পেয়ে যেতো বহু রাষ্ট্রের। ভারত সরকারের সক্রিয় সাহায্য ছাড়াই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনে সমর্থ হতো।
রণাঙ্গনের সৈনিক লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী তার ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে একাত্তরের ৭ই মার্চ সম্পর্কে বলেন, “ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আনুমানিক দশ লক্ষাধিক লোকের বিশাল জনসমুদ্রে বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক তেজোদীপ্ত ভাষণে বলেন, ভাইয়েরা আমার, আজ অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।

আপনারা সবই জানেন এবং…” উক্ত গ্রন্থে মন্তব্য করা হয়, “ঐ দিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন, এমন আশা অনেকেই করেছিলেন। অনেকের মতে মেজর ওসমানও মনে করেন যে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রকে সাথে নিয়ে অগ্রসর হলে কয়েকশ’ বা কয়েক হাজার প্রাণের বিনিময়ে হলেও ঢাকা সেনানিবাস দখল করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেদিন নেতা আমাদের তথা সব বাঙালীদেরই হতাশ করেছেন।”
এমনকি প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাসও মন্তব্য করে বলেন, “জনগণের একজন বিপ্লবী নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রধান যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তার প্রতি তার আস্থা থাকলে তিনি টিক্কা খানের আত্মসমর্পণের দাবি করে তাকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য দৃঢ় মনোভাবাপন্ন লাখ লাখ বাঙালীকে চার মাইল দূরে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সেনানিবাসে পাঠাতেন। বাঙালীরা তা করার জন্য প্রস্তুত ছিল এবং সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার জন্য সানন্দে কয়েকশ’ লোক জীবন বিসর্জন দিতো। তখন ন্যূনতম রক্তপাতে বাংলাদেশ বাস্তবে রূপ লাভ করতো। পরবর্তীকালে কিছুতেই লাখ লাখ লোক নিহত হতো না এবং সেনাবাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে অগণিত লোক দেশ ত্যাগ করতো না।”

এদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রকাশিত “স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী স্মারক গ্রন্থে’’ উল্লেখ করা হয়, “৭ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপনামূলক ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’- প্রবাসী বাঙালীদের উদ্বুদ্ধ করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে উত্তেজিত ছাত্র ও যুবকরা পাকিস্তানী ছাত্রাবাসের দেয়াল থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি খুলে পায়ের তলায় ফেলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি তাদের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করে।” উল্লেখিত তারিখে পূর্ব পাকিস্তান ভবনে অনুষ্ঠিত এক গণসমাবেশে পূর্ববঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তাব গৃহিত হয়।