সূরা আর-রুমের চোখে বিশ্ব দে‌খি

জামাল আস-সাবেত

সূরা রুম পড়ছিলাম। পড়তে পড়তে কখন যে ভাবনার জগতে হারিযে গেলাম বুঝতে পারিনি। নিজের অজান্তেই সূরাটি কয়েকবার  শেষ করলাম। মানুষ মোহমুগ্ধ হলে যেমন সে জিনিস থেকে বের হয়ে আসতে পারেনা ঠিক তেমনটি হয়েছে।

সূরাটি অর্থসহ পড়ছিলাম, প্রতিটি বাক্য যেন বাস্তবতার নিরিখে সাজানো হয়েছে। যেন, বর্তমান সময়ে কেউ সূরাটি রচনা করেছে। এতোটাই বাস্তবসম্মত!
কথাগুলো বারবার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। এতো চমৎকার কথা কখন আপনাদের সাথে শেয়ার করবো তাই ভাবছিলাম। অবশেষে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে লিখতে বসলাম।

এ সুরার দ্বিতীয় নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, “রোমকরা পরাজিত হয়েছে।”

আয়াতটি পড়েই চমকে ‍উঠলাম! আয়াতটি যখন নাযিল হয়েছিলো তখনও রোমকরা বহাল তবিয়তে শাসন কার্য পরিচালনা করছিলো। অথচ এখানে বলা হচ্ছে, রোমকরা পরাজিত হয়েছে! কীভাবে সম্ভব! হাঁ, ইতিহাস তাই বলছে, হযরত মোহাম্মদ সাঃ যখন রোমের বাদশাহ হিরাক্লিয়াসকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন, তখন হিরাক্লিয়াস হযরতের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিলো। পরবর্তীতে হযরত ওমর রা:-র শাসনামলে রোমকরা মুসলমানদের হাতে ইয়ারমুকের যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলো। যার বদৌলতে মুসলমানরা ফিলিস্তিন, মিশর ও সিরিয়া দখল করতে সমর্থ হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, পরবর্তীতে এ দুর্বল রোমান তথা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য কেবল কন্সটান্টিনোপোল শহরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৪৫৩ সালে তাদের উপর চূড়ান্ত আঘাতটি করেন
ওসমানীয় সুলতান মুহম্মদ বিন ফতেহ। ওসমানীয়রা কন্সটানটিনোপলের নাম পরিবর্তন করে ইসলামবুল রাখেন, যা পরবর্তীতে তুরস্কের সেক্যুলারাইজেশনের সময় গ্রীককরণ করে ইস্তানবুল লিখা হয়।
উল্লেখ্য যে, কোরআনে যে রোমকদের কথা বলা হয়েছে, তা ইতালির ওয়েস্টার্ন রোমকদের নয়। বরং ইস্টার্ন রোমাকদের বুঝানো হয়েছে। যারা তুরস্কে বাস করা বাইজান্টাইন।

বেশ চমৎকার! সূরাটির শুরুতেই ভবিষ্যতে কী ঘটে তারও একটা সত্য ঘটনা পেয়ে গেলাম।

এতে সূরাটির প্রতি কযেকগুণ আগ্রহ বেড়ে গেল। সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। যতই এগুচ্ছি ততই বিস্মিত হচ্ছি! সূরার ৯ নাম্বার আয়াতে এসে দেখলাম , বলা হচ্ছে, “তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? অতঃপর দেখেনা যে, তাদের পূর্ববর্তীদের পরণিাম কী হয়েছিল?”

থমকে গেলাম! মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আমাকে জোরগলায় নির্দেশ দিচ্ছে, বের হও। শিক্ষার জন্য দেশ- বিদেশ ঘুরে বেড়াও। তারপর ভ্রমণ সম্পর্কে মনীষীদের মতামত কী তা জানার চেষ্টা করলাম। জেফারসনস বলেন, ‘ভ্রমণ মানুষকে জ্ঞান অর্জণ করতে সাহায্য করে।’ গুস্তাভ ফ্লুবেয়ারের মতে, ‘ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। সে জানতে পারে ‍দুনিয়ার তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র।’ আল-কোরআন সরাসরি বলছে, ‘পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে দেখ।’ আমাকে কে যেন বলছে, ইতিহাস জানো। ইতিহাস না জানলে কখনোই সঠিক পথ পাবে না। ইতিহাস তোমাকে ভুল থেকে বাঁচাবে।
তৎক্ষণাত ইংরেজ কবি পার্সি বিশি শেলির বিখ্যাত কবিতা, ‘ওজিমানদিয়াস’ -এর কথা স্মরণে আসলো। খুররম হোসাইন অনূদিত বইতে বলা হয়েছে, “কালের প্রচণ্ড দাপটের কাছে শক্তি এবং অহমিকা যে একেবারে তুচ্ছ তারই প্রকাশ ঘটানো হয়েছে কবিতাটিতে।প্রাচীন মিশরে নিজ শক্তিতে গর্বিত একজন স্বেচ্ছাচারী রাজা ছিলেন। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার অহংকার এবং শক্তি দুটোই ধুলোয় মিশেছে।” ঠিক যেন এ সম্পর্কে সূরাটির ১০ নাম্বার আয়াতে কী অবলীলায় বলে দিলো, “অতঃপর যারা মন্দ কর্ম করতো, তাদের পরিণাম হয়েছে মন্দ।” স্ট্রেঞ্জ না হয়ে থাকা যায়!

তারপর বিশ থেকে পঁচিশ নাম্বারে যখন গেলাম, দেখলাম সরাসরি কিছু নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি যে, পবিত্র কোরআনের বাক্যগুলোকে আরবিতে ‘আয়াত’ বলা হয়। এর অর্থ হচ্ছে, সাইন বা নিদর্শন। নিদর্শন শব্দের অর্থ হচ্ছে, ১. উদাহরণ,২. চিহ্ন। সূরাটির ২২ নাম্বারে বলা হচ্ছে, “তাঁর (আল্লাহর) আরো এক নিদর্শন হচ্ছে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।” বলা হচ্ছে, ভাষা ও বর্ণভেদে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছ। দেখি এ ব্যাপারে জ্ঞানীরা কী বলে। ভাষা নিয়ে লেনসন ম্যান্ডেলা বললেন, “যদি তুমি কারো সাথে তোমার ভাষায় কথা বলো, তার কাছে যেতে পারবে; যদি তার ভাষায় কথা বলো, তার হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারবে।

” ভাষা যে কত বিচিত্র! সেদিন ডিবিসির একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, তুরস্কের একটি অঞ্চলে মানুষ পাখির ডাকের মতো কথা বলে! যা এক কিলোমিটার দূর থেকেও একে অন্যের সাথে কমিউনিকেট করতে পারে!’ ভাষা বলতে আমরা সচরাচর যা বুঝি, বিষয়টি আসলে তা নয়। বলা হয় যে, পৃথিবীতে মোট জীবিত ভাষা আছে, তিন হাজার।
মূলত ভাষার সংখ্যায় এটি অনেক কম। ভাষার লেখ্য রূপ যা আছে তার চেয়ে অধিক আছে কথ্য রূপ। এছাড়াও হাতের নড়াচড়া এবং চোখের ইশারার মাঝেও ভাষা রয়েছে। শুধু তাই নয়, শিশুর একটি ভাষা আছে,মানুষের হাসি-কান্নার মাঝে ভাষা আছে, বাক্ প্রতিবন্ধীদের ভাষা আছে, আকার -ইঙ্গিতের ভাষা আছে, প্রত্যেক প্রাণীকূলের নিজস্ব একটি ভাষা আছে (ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, হযরত সোলায়মান আঃ প্রাণীজগতের ভাষা বুঝতেন), পৃথিবীতে এরকম হাজারো ভাষা রয়েছে, যা গণনা করা অসম্ভব।
বর্ণের বিচিত্র- আমরা সৌন্দর্য বলতে যা বুঝি, তাতেও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কেবল চামড়ার সাদা রঙকেই সুন্দরের অন্তর্ভুক্ত করি, যা মোটেই ঠিক নয়। প্রতিটি রঙের মাঝেই সৌন্দর্য বিরাজ করে। আমরা যে রংধনু দেখি তা সাতটি রঙের সংমিশ্রণ। রংধনুতে একটামাত্র রঙ থাকলে তার প্রতি মানুষের ওতোটা আকর্ষণ থাকতো না। বিভিন্ন রঙের ছোঁয়া আছে বলেই তার প্রতি মানুষের এতোটা আকর্ষণ। মানুষের রঙের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বর্ণ বলতে আবার জাতিগোষ্ঠীকেও বুঝানো হয়েছে। বিশ্বে বিভিন্ন জাতি থাকার কারণেই শিক্ষার প্রসার হয়েছে অনেক। কারণ জাতভেদে বৈশিষ্ট্যে ভিন্নতা রয়েছে।

আমি যখন আয়াতগুলো পড়ছিলাম, তখন মনের মধ্যে কিছু সাধারণ প্রশ্ন জাগলো, বিশ্বজুড়ে মুসলমান মুসলমানে এতো দ্বন্দ্ব কেন? দেশে দেশে এতো দল কেন? পবিত্র কোরআনের এসব সুন্দর সুন্দর কথাগুলো কি তারা পড়েন না?

আমি যখন এ কথাগুলো দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভাবছিলাম , ঠিক এর পরেই সূরাটির ৩২ নাম্বার আয়াতে এসে বিহ্বল হয়ে গেলাম! আয়তটিতে খুব সুন্দর করে বলা হচ্ছে, “যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করছে, এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে, প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত।” এ আয়াত পড়ার পর নিজেকে এতোটা অসহায় লাগছে! এ আয়াতের ব্যাখ্যা কী হবে তা পাঠক নিজ দায়িত্বে বুঝবেন। কারণ মুসলিমদের সামগ্রিক চিত্র দু-একবার চোখ বুলালে বিভেদের কারণ সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন, যা এ আয়াতে বলা হয়েছে।

এরপর সূরাটির ৪১ নাম্বার আয়াতে বলা হচ্ছে, “জল ও স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ছে।” এ আয়াতটিতে যে, জলবায়ু বিপর্যয়ের কথা বলা হচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।

এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে জলবায়ু বিষয়ক বিজ্ঞানী প্যানেল পৃথিবীর ভবিষ্যতকে ‘রেড এলার্ড’ দিয়ে জানিয়েছে, মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত হারে সাগর-পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। তারা বলছেন, বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ার কারণে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে, পরিস্থিতি দিনকে দিন বিপজ্জনক হযে পড়ছে। ড. জ্যঁ পিয়ের বলেন, “ব্লু-প্ল্যানেট (পৃথিবী) এখন মহা-সঙ্কটে । বিভিন্ন দিক থেকে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, এবং এর জন্য আমরাই দায়ী।” জাতিসংঘের ঐ রিপোর্টে সাবধান করা হয়েছে, সাগরে তাপ বাড়ার ফলে, আবহাওয়া দিনকে দিন বিপজ্জনক আচরণ করবে। সামুদ্রিক ঝড় বেশি হবে, জলোচ্ছ্বাস বাড়বে।

এ রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের বেশ কিছু জায়গায় খুব বড় মাপের জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।” প্যানেলের অধ্যাপক ডেরা রবার্টস বলেন, “আমরা নজিরবিহীন কিছু বিপদের ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি।”-সূত্রঃবিবিসি। অবস্থা যে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে সহজেই বোধগম্য। এতে আরো বলা হয়েছে, আপনি যদি স্থলভাগের খুব ভিতরেও বসবাস করেন, তাহলেও সাগর এবং পরিবেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আপনি নিরাপদে থাকতে পারবেন না।

সূরার ৫৮ নাম্বার আয়াতে বলা হচ্ছে, “আমি এই কোরআনে মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছি।”

সূরাটি ৬০ নাম্বার আয়াত বিশিষ্ট পবিত্র কোরআনের ৩০-তম সূরা। কেউ যদি পুরো সূরাটি বিশ্লেষণসহ পড়ে তাহলে তিনি জ্ঞানের রাজ্যে অভিনন্দিত হবেন। ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, পরিবেশ-বিজ্ঞান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, বিপদগামী মানুষদের পরিণতি, মানুষের সহজ-সরল পথ কোনটি, পৃথিবীতে মানুষের আসার উদ্দেশ্য কী ইত্যাদি বিষয়ের ইঙ্গিত পেয়ে যাবেন।

জামাল আস-সাবেতঃ লেখক ও কলামিস্ট
jamalassabet@gmail.com