সত্যের ডানা মেলে দাও

জামাল আস-সাবেত

ইসলাম এমন একটি জীবনের কথা বলে, যা সেবার কাজে নিয়োজিত। সেবা ছাড়া এ ধর্ম নিষ্ক্রিয়। যখন থেকে ইসলাম ধর্মালম্বীদের মাঝে সেবার কার্য উঠে গেছে, তখন থেকেই তারা হয়েছে স্বার্থান্ধ।

ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ইসলাম ধর্ম প্রসারের মূলে ছিল ‘হিতৈষী’ কার্যক্রম। মুসলিমদের মধ্যে সত্যিকারের যাঁরা স্কলার ছিলেন, তাঁরা ‘নিঃস্বার্থ ও হিতাকাঙ্খী’ গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ইসলামকে তাঁরা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সাধারণের পর্যায়ে। তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজ-বান্ধব ইসলাম প্রচার করেছিলেন।

তাঁরা বরাবরই সংস্কার-পন্থি এবং মানব ও সমাজ উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ছিলেন। তাঁরা সরকার ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। বরং সরকারের নির্ভরযোগ্য পরামর্শদাতা ও জনগণের পরম-বন্ধু ছিলেন। তাঁরা কখনো গোঁড়া প্রকৃতির ছিলেন না। ছিলেন উদার ও প্রশস্ত বক্ষের অধিকারী।

তাঁদের উপস্থিতি ছিল সম্মানের; অবহেলার নয়। সহজ কথায়, তাঁরা ছিলেন সেবক। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, আধ্যাত্মিকতা কেবল নির্দিষ্ট কোন ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং আধ্যাত্মিকতা অর্জন করতে হলে, পুরোধা সমাজ-সেবক হতে হয়। ইতিহাসে দেখা যায়, লঙ্গর-খানা, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং অনাথ আশ্রম ইত্যাদি মানবসেবা-মূলক কার্য-সমূহ মুসলিমদের এলাকাগুলোতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। যেখানে হতদরিদ্র, গরিব, মুসাফির, আশ্রয়হীন মানুষ খেতে পারতো এবং আশ্রয় লাভ করতে পারতো। সেখানে যে-কোনো ধর্মের-বর্ণের লোক আসতে পারতো কোনোরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই।

তাঁরা বিশ্বাস করতেন, ইসলামের মূল শিক্ষা হচ্ছে, ভালোবাসা এবং সেবা। এ দু’য়ের সংমিশ্রণ যে ঘটাতে পারবে, সে-ই আল্লাহর সবচেয়ে কাছের মানুষ হিসেবে গণ্য হবে। জনসাধারণেরও প্রিয় হবে।

ইসলামের স্বর্ণযুগগুলোতেও সে-সবের প্রমাণ মেলে। জ্ঞানে-গুণে যখন আমরা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম, তখনই আমরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহন করেছিলাম। যখনই আমাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটলো, দলাদলি প্রবেশ করলো তখনই আমরা বিশ্বের কাছে হেরে গেলাম। পৃথিবীর শাসনভার দখল করে নিলো অত্যাচারীরা।

আজও আমাদের ঘুম ভাঙেনি। আমরা আমাদের আদর্শ চর্চা করতে পারিনি। সঠিক চিন্তা নিয়ে এগুতে পারিনি। এখনো পুরনো চরিত্র বদলাতে পারিনি।

তুরস্কের আয়া সোফিয়া যখন আমাদের হস্তগত হলো, তখন আমাদের আদর্শের দিকে ফিরে তাকানো উচিত। আদর্শের দিকে ধাবিত হওয়া উচিত। কেবল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবারো আড়মোড়ে ঘুমিয়ে গেলে চলবে না। আমরা এখনো মার খাচ্ছি। এখনো আমাদের বুক ফেড়ে রক্ত বের হচ্ছে। আমাদের ইজ্জত ভূ-লুণ্ঠিত হচ্ছে। মাথার উপর এখনো বোমা ফাটছে। আমাদের ভূমি জোর করে দখল করে নিচ্ছে। তারা যখন আমাদের সামনেই ওদের জয়ের পতাকা উড়িয়ে দিবে, তখন আল্লাহর কাছে আমরা কী জবাব দিবো?

আমাদের চতুর্দিকে শত্রু। মসজিদ পোড়ানো হচ্ছে। মসজিদ ভাঙ্গা হচ্ছে।

যারা আমাদের চোখের উপর চোখ রাখতে দশবার ভেবে নিতো, তারা এখন আমাদের দিকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলছে!

ফিলিস্তিন, সিরিয়ায় বোমা ফেলছে। বেধে নিয়ে ধর্ষণ করছে আমাদের নারী সম্ভ্রম। পৃথিবীর বুকে আমরা লাঞ্ছিত। এক আয়া-সোফিয়ায় নামাজ পড়তে আমাদের দীর্ঘ ছিয়াশি বছর লেগে গেলো!

এজন্য আমাদের একতাবদ্ধের বিকল্প নাই।একমাত্র সেবার মাধ্যমেই আমরা একে-অন্যের কাছাকাছি আসতে পারবো। শত্রুতা ভুলে যেতে পারবো। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, আমাদের জ্ঞান, আমাদের তরবারি ন্যায়ের জন্য। দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার জন্যে নয়।

আমাদের সেবা সবক্ষেত্রে পৌঁছে দিতে হবে। কেবল দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারলেই ধর্মের সেবা হয় না। কাজে-কর্মে, নৈতিকতায়, শিক্ষা-দীক্ষায়, চিকিৎসায়, বিচারে-আচারে আমাদেরকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে।

আমাদের পুনর্জাগরণ জরুরি। আমরা কেন বেঁচে আছি, ইসলামের কী সেবা করছি, পৃথিবীকে কী সেবা দিচ্ছি সে-সব প্রশ্ন নিজের ভিতর লালন করা দরকার।

কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী মুসলিমদেরকে উজ্জীবিত করে বলেন,

“আবার উত্থান লক্ষে
বহাও জগৎ বক্ষে
নব-জীবনের খর প্রবাহ প্লাবন।
আবার জাতীয় কেতু
উড়াও মুক্তির হেতু
উঠুক গগণে পুনঃ রক্তিম তপন।”

ব্যাঙের ছাতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা দরকার। মুক্ত গগনে চোখ মেলে তাকানো দরকার। আকাশের চেয়ে আমাদের চিন্তাচেতনা কত ক্ষুদ্র তা ভাবা দরকার।

শিক্ষার অগ্রগতি হওয়া দরকার। শিক্ষাকে সমাজ, দেশ ও পৃথিবীর প্রয়োজনে কাজে লাগানো দরকার। দক্ষ জনশক্তি যতদিন পর্যন্ত তৈরি করতে না পারবো, ততদিন আমরা সমাজ ও দেশ থেকে পিছিয়ে থাকবো।

এমন লোক তৈরি করতে হবে, যারা নেতৃত্ব দিবে, সঠিক সিদ্ধান্ত দিবে, যে কোনো বিভাগে সফলতার সাথে কার্যক্রম চালাতে পারবে। ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিতে হবে মানবের হৃদয়ে হৃদয়ে। প্রতিটি মানুষ যেন ইসলাম থেকে উপকৃত হতে পারে, সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। চাই সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইহুদী, নাস্তিক যে-ই হোক না কেন, তাকে সেরা আচার-আচরণ দিয়ে মুগ্ধ করতে হবে। ইসলামের কল্যাণ যাতে তারাও ভোগ করতে পারে সে সুযোগ করে দিতে হবে।

মুখে মুখে আদর্শ চর্চার চেয়ে, কাজে আদর্শের চর্চা হোক। মানুষকে জানানো হোক, আমরা কথা এবং কাজে এক। উগ্রতা নয়, নমনীয়তা আমাদের স্বভাব। ঘুমন্ত মুসলিমকে জাগিয়ে তুলতে কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী বলেন,

আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া
উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া।
পূত বিভু নাম স্মরণ করি।

… অইরে মোসলেম! দেখরে চাহিয়া
নির্জীব যে জাতি তারাও সাজিয়া
তারাও কেমন সাহস ধরিয়া
উন্নতির পথে ধাইছে ছুটি।

তোমাদের তরে নিদ্রিত দেখিয়া
প্রকাশ্যে তোদেরে অবজ্ঞা করিয়া
দেখরে কেমন চলিছে ছুটিয়া
দেখরে মেলিয়া নয়ন দুটি।

কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মতো আমাদের হৃদয়ে সত্যের বীণা বাজতে হবে। সত্যের জন্য লড়তে হবে। তবেই আমাদের মুক্তি মিলবে। মুক্তি মিলবে পৃথিবীরও।

লেখকঃ লেকচারার ও কলামিস্ট
Email: jamalassabet@gmail.com