মহান বিজয় দিবস আজ

ইলিয়াছ পাটওয়ারী

আজ মহান বিজয় দিবস। স্বাধীনতার চার যুগেও প্রকৃত অর্থে শোষণ মুক্তি নয় বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিবস। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখন্ডের নাম জানান দেয়ার দিন। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানী বাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। সেই থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালিত হয়ে আসছে বাঙ্গালী জাতি। অফুরন্ত আত্মত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই মহান বিজয়ের ৪৮ বছর পূর্ণ হলো আজ।

জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসার সঙ্গে স্মরণ করবে সেইসব শহীদদের যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। স্মরণ করবে সেইসব বীর সেনানীদের যারা শোষণ বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেয়ার জন্য প্রাণের মায়া ত্যাগ করে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যেসব নর-নারীর সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সম্মান জানানো হবে। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নামবে। শ্রদ্ধার সাথে তারা শহীদের উদ্দেশে নিবেদন করবেন পুষ্পাঞ্জলি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সব প্রান্তের মানুষ অংশনেবে বিজয় দিবসে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিন আজ। এবারো মহান বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে চাঁদপুর জেলা শহরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। আজ ১৬ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে চাঁদপুরে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘অঙ্গীকার’ পাদদেশে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচির শুভ সূচনা করা হবে। এরপর অঙ্গীকার বেদীতে সকল শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি প্রদ্ধা নিবেদন করে প্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করা হবে।

সরকারিভাবে গৃহীত অন্যান্য কর্মসূচি : আজ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সাড়ে ৮টায় চাঁদপুর স্টেডিয়ামে জেলা প্রশাসক কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর পর পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, বিএনসিসি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, কারারক্ষী, রোভার স্কাউটস্, গার্লস গাইড ও কমিউনিটি পুলিশসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী-ছাত্রী এবং অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ এবং এর পর পর শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে ক্রীড়ানুষ্ঠান, ডিসপ্লে প্রদর্শন ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত হবে।

সকাল ১১টায় চাঁদপুর সার্কিট হাউজে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। চাঁদপুর স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা। এছাড়া সকাল ১১টায় সকল সিনেমা হলে বিনামূল্যে ছাত্র-ছাত্রী ও শিশু-কিশোরদের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও সংশ্লিষ্ট উপ-কমিটির ব্যবস্থাপনায় দিনের সুবিধাজনক সময়ে সকল মসজিদে জাতির শান্তি, অগ্রগতি ও শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ দোয়া এবং সকল মন্দির, গীর্জা ও উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা, দুপুরে সরকারি হাসপাতাল, এতিমখানা, জেলখানা, সরকারি শিশু পরিবার, মূক ও বধির বিদ্যালয়ে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন, বিকেল ৩টায় পুরাণবাজার মধুসূদন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পৌর মেয়রের ব্যবস্থাপনায় প্রীতি হা-ডু-ডু প্রতিযোগিতা,

একই সময় চাঁদপুর স্টেডিয়ামে জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থাপনায় বিজয় দিবস ভলিবলের ফাইনাল খেলা এবং বাবুরহাট হাইস্কুল এন্ড কলেজ মাঠে প্রীতি ফুটবল প্রতিযোগিতা, বিকেল সাড়ে ৩টায় চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ মাঠে জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থাপনায় কলেজ পর্যায়ের ছাত্রীদের ক্রীড়ানুষ্ঠান এবং একই সময়ে চাঁদপুর স্টেডিয়ামে জেলা প্রশাসক একাদশ বনাম চাঁদপুর পৌরসভা একাদশের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা মঞ্চে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ‘সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তির সার্বজনীন ব্যবহার এবং মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক আলোচনা সভা, আলোচনা শেষে জেলা প্রশাসন ও জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ব্যবস্থাপনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে চাঁদপুর পৌরসভার উদ্যোগে শহরের শপথ চত্বর, ইলিশ চত্বর ও পৌর ভবন আলোকসজ্জা করা হয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসকের বাসভবনসহ বিভিন্ন সরকারি বাসভবন আলোকসজ্জা করা হয়েছে। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পৃথক পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। স্থানীয় সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে, বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

জেলা আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চাঁদপুর জেলা শাখার উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস পালনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচি : আজ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান, এরপর কার্যালয় থেকে মিছিল সহকারে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য অঙ্গীকার বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জেলা প্রশাসন আয়োজিত সরকারিভাবে গৃহীত সকল কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা প্রদান ও সন্ধ্যায় বিজয় মেলা মঞ্চে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ।

জেলা বিএনপি
মহান বিজয় দিবস পালনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ ভোর সাড়ে ৬টায় জেলা বিএনপি কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, ৭টায় অঙ্গীকার বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং সকাল ৮টায় জেলা বিএনপি কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

জেলা জামায়াতে ইসলামী
বাংলাদেশের মহান বিজয়ের ৪৮তম বার্ষিকী এ দিনে চাঁদপুর জেলা জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন কর্মসুচী গ্রহন করেছে। জেলা জামায়াতের কার্যালয় ও উপজেলা কার্যালয় জাতীয় ও দলীয় প্রতাকা উত্তলন। সকল শাখা ও ইউনিটে দোয়া মুনাজাত ও আলোচনা সভা আয়োজন করা হবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার শপথে এবার বিজয় বার্ষিকী পালন করছে জাতি। সমালোচকরা বলছেন, যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের কথা বলছেন তাদের কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে উল্টো পথে। পাকহানাদার বাহিনীর মতো তারা গণতন্ত্রকামী মানুষদের হত্যা-গুম করছে, জনগণের ভাষা শাসকগোষ্ঠী বুঝতে চাইছে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে বর্তমানে যে শাসন ব্যবস্থা চলছে সরকার একে গণতন্ত্র বললেও প্রকৃতপক্ষে তা স্বৈরতন্ত্রেরই ভিন্ন রূপ। একদলীয় কিংবা কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েমে মত্ত সরকার। অবশ্য বিবেকের তাড়না থেকে সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ সাম্প্রতিক সময়ে চলমান শাসন ব্যবস্থাকে ‘সীমিত গণতন্ত্র’ বলছেন।

পাকিস্তনের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নিয়াজী তার ৯১ হাজার ৫৪৯ জন পরাজিত পাকসেনাসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। অবসান ঘটে পাকিস্তানী অত্যাচার আর নির্যাতনের। পাকিস্তানী সৈন্যের এ আত্মসমর্পণ ছিলো মূলত যৌথ বাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল মো. আতাউল গণি ওসমানী। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছতে পারেননি। তার বদলে এসেছিলেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ (পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এবং মন্ত্রী) এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। যুদ্ধের নিয়মে এ দিনই পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে।

বিজয়ের এই ৪৮ বছর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে জাতি। কখনো সামনে এগিয়েছে, আবার পিছিয়ে গেছে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়নে। তবুও হতোদ্যম হয়নি জাতি। হার না মানা বাঙালি আর্থ-সামাজিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উড়াচ্ছে বিজয় নিশান। তবে গণতন্ত্রের জন্য কষ্টটা সবার রয়েই গেলো।