প্রকট হচ্ছে গ্যাস সংকট

এক সময় বলা হতো গ্যাসের উপর ভাসছে বাংলাদেশ। কিন্ত  দিন যতই যাচ্ছে ততই সংকটে বেড়েই  চলেছে  গ্যাসের। ফলে গ্যাসের উপর বাংলাদেশ ভাসছে সে কথাটি আর ঠিক থাকছে না। বিদ্যমান খনিগুলোর মজুদ নিয়েও রয়েছে উদ্বেগ। এখন পর্যন্ত যেটুকু মজুদ আবিষ্কার হয়েছে, সেটিও ফুরিয়ে আসবে শিগগিরই। যদিও দুই দশক আগেও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে।

সূত্র জানায়, দেশে গ্যাস সংকট দীর্ঘদিনের। প্রায় সব ধরনের সংযোগ এক রকম বন্ধই রয়েছে। বহু বছর থেকে দেয়া হচ্ছে না আবাসিক গ্যাস সংযোগ। আর আবাসিক গ্যাস সংযোগ আদৌ আর দেয়া হবে কি না তার কোন উত্তর নেই কারোর কাছে। এছাড়া শিল্প গ্যাস সংযোগ পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণের মতো। জ্বালানি খাতের সংকট নিরসনে স্থায়ী সমাধান বা সুনির্দিষ্ট পথ খুঁজে বের করার উদ্যোগ তুলনায় কমই দেখা যাচ্ছে।

সূত্র জানায় বিশ্বব্যাপী জ্বালানি নিয়ে একরকম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর বাইরে নয় বাংলাদেশ। সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের ক্রমাগত দর বৃদ্ধিতে সংকটে পড়েছে বিভিন্ন দেশ। এ দুর্বিপাকের বাইরে নয় বাংলাদেশও। দেশে এখন জ্বালানি পণ্যের, বিশেষ করে গ্যাস সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলিত গ্যাস সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায়

উচ্চমূল্যে আমদানির মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

সূত্র জানায়, ভবিষ্যত জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় সাম্প্রতিককালে এ নিয়ে কিছু কর্মতৎপরতা দেখা যাচ্ছে। সিলেটের জকিগঞ্জে দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের বড় একটি মজুদ রয়েছে। এছাড়া গ্যাস অনুসন্ধানে ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাপেক্স। তবে এ মুহূর্তে প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি হলেও এর সুফল পেতে সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তথ্য অনুযায়ী, চার-পাঁচ বছর আগেও দেশে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ছিল ২৭০ কোটি ঘনফুট। এখন তা কমে ২৪০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত দেশে গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হয়েছে (জকিগঞ্জ-১ গ্যাসক্ষেত্র বাদে) ২৮ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এর মধ্যে নিশ্চিতভাবে উত্তোলনযোগ্য সাড়ে ২১ টিসিএফ। সম্ভাব্য উত্তোলনযোগ্য ৬ দশমিক ৭৯ টিসিএফ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে মধ্যে ১৮ দশমিক ২৪ টিসিএফ। সে হিসেবে বর্তমানে গ্যাসের নিশ্চিতকৃত ও সম্ভাব্য মিলিয়ে উত্তোলনযোগ্য মজুদ রয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৫ টিসিএফ, যা এক দশকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

সূত্র মতে, দেশের গভীর-অগভীর সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধান ক্ষেত্রগুলোকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে।

এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৩টি ও অগভীর সমুদ্রে ১৩টি ব্লক রয়েছে। এসব ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে জরিপ প্রয়োজন। সাগরের খনিজ সম্পদ সম্পর্কে ধারণা পেতে জরিপের জন্য কয়েকবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়েছে। যদিও প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার তাদের অফশোর-অনশোরে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। দেশীয় গ্যাস কূপগুলোর উন্নয়নে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে ওয়েলহেড কম্প্রেসার বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৪ সালে। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশনা থাকলেও গত সাত বছরে তা শেষ করা যায়নি।

জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমানের মতে, জ্বালানি খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে নানামুখী সংকট ছিল। হয়তো থাকবেও। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বড় একটি সময় আমরা হারিয়ে ফেলেছি। গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্সকে দীর্ঘ সময় ধরে বসিয়ে রেখেছি। কিন্তু বাপেক্সের যে সক্ষমতা রয়েছে, সম্প্রতি বেশকিছু কাজে তার প্রমাণ মিলেছে। তবে এতদিন জ্বালানি নিয়ে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন না হলেও এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাপেক্সের কর্মপরিধি বাড়াতে দেশব্যাপী অনুসন্ধানের কার্যক্রম বিস্তৃত করা হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে হয়তো গ্যাস সংকট কমে আসবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, আমদানিনির্ভরতা কখনই একটি দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের নির্ভরযোগ্য পথ হতে পারে না। কারণ এলএনজির মতো জ্বালানি পণ্যের দাম কখনই বিশ্ববাজারে স্থিতিশীল নয়। ফলে এ ধরনের জ্বালানি নিয়ে বৃহদায়তনের পরিকল্পনা গড়ে তোলাও ঝুঁকিপূর্ণ। বছরের পর বছর ধরে আমরা বলছি, আমাদের দেশে গ্যাস প্রাপ্তির বহু সম্ভাবনা রয়েছে। অফশোর-অনশোরে বিস্তৃত আকারে অনুসন্ধান প্রয়োজন। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। গত ২০ বছরে শুধু গ্যাস ব্যবহারই করে গিয়েছি। নতুন করে গ্যাস সরবরাহের স্থায়ী কোনো পথ খুঁজে বের করতে পারিনি।