ডলারের বাজারে আগুন

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে হঠাৎ অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করেছে মার্কিন ডলারের মূল্য। গতকাল গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, ডলারের মূল্য শুধু বাড়ছেই না, বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতাকে বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রতিহত করতে পারছে না। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলারের মূল্য ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু নির্ধারিত সে মূল্য অনুযায়ী লেনদেন হচ্ছে না। খুচরা বাজারে এমনকি ৮৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হচ্ছে প্রতি ডলারের। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রফতানি। এর ফলে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে পণ্যের বাজারে।

উল্লেখ্য, গত ৩ জুনও ডলারের নির্ধারিত মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা। কিন্তু আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হলেও বৈদেশিক মুদ্রার খুচরা বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করা হয়েছে। অঘোষিতভাবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সোনার ব্যবসায়ীসহ চোরাচালানীরা। সবার মিলিত কর্মকান্ডের পরিণতিতে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই ডলারের বাজার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠেছে। ব্যাংকগুলোও এর বাইরে যেতে পারছে না। খবরে জানা গেছে, বিদেশিসহ প্রায় সব ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন- বাফেডা’র নির্দেশনা উপেক্ষা করে চলেছে এবং যার যেমন খুশি তেমন মূল্যে ডলার কেনা-বেচা করছে। এর ফলে ৩ জুন ডলারের আন্তঃব্যাংক দর যেখানে ছিল ৮৪ টাকা ৯৫, সেখানে কোনো কোনো ব্যাংক এমনকি ৮৮ টাকা দরেও ডলার বিক্রি করেছে। ব্যাংকের পাশাপাশি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোও ইচ্ছামতো ডলারের মূল্য আদায় করেছে। ফলে ডলারের দাম উঠেছে ৯০ টাকা পর্যন্ত।

সবই ঘটছে গত মাস দেড়-দুই ধরে। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে এসেছে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রতিক্রিয়া। সেই সাথে যোগ হয়েছে একই করোনার কারণে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমে যাওয়া। তাছাড়া বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রফতানি আদেশ বাতিল হওয়ার কারণেও ডলারের বাজারে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ ডলার সংকটের পেছনে রয়েছে রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয় কমে যাওয়া।

হঠাৎ করে মার্কিন ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদসহ তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, রফতানি আয় কমলেও বাংলাদেশের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানির জন্য বিপুল পরিমাণ আমদানি ঋণের দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিভিন্ন সেবাখাতের আমদানির ব্যয়ও এ সময়ই মেটাতে হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে করোনার কারণে টানা দু’মাসের বেশি ছুটি ও লকডাউন। এসব কারণেই মার্কিন ডলারের ওপর প্রচন্ড চাপের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক।

এমন অবস্থায় সরকারের প্রতি সরাসরি হস্তক্ষেপ করার অহবান জানিয়েছেন দেশপ্রেমিক অর্থনীবিদসহ বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, ডলারের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও অস্থিরতার একটি বড় কারণ আসলে অবৈধ পথে টাকার পাচার। জানা গেছে, করোনার কারণে পাচার কমেছে বলে মনে হলেও কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা, ঠিকাদার ও অসৎ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাসহ আরো অনেকেই দেশে টাকা রাখার চাইতে বিদেশে পাচার করে দেয়াকে নিরাপদ মনে করছেন। তাদের ধারণা, কিছুদিন পর্যন্ত মৃত্যু ও মহামারির শিকার হয়েছে সত্য, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো সহসাই সংকট কাটিয়ে উঠবে। সেসব দেশে তাই করোনার চিকিৎসাও সহজলভ্য হবে। এজন্যই তারা কথিত সেকেন্ড হোমে টাকা পাঠানোর পাশাপাশি টাকা জমাচ্ছেনÑ যাতে প্রয়োজনের সময় তারা বাংলাদেশ থেকে ওইসব দেশে পাড়ি জমাতে পারেন।

বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা থাকায় পাচারকারী ব্যক্তিরা হুন্ডিসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। বর্তমান পর্যায়েও তেমন অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছে। আর টাকা যেহেতু পাচার করা যায় না এবং করা গেলেও সেটা যেহেতু লাভজনক ও নিরাপদ নয় সেহেতু সংশ্লিষ্টজনেরা মার্কিন ডলারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। একই কারণে রাতারাতি ডলারের দামও বাড়তে শুরু করেছে। তথ্যাভিজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, পাচারের এই ধারা প্রতিহত না করা গেলে ডলারের দাম তো বাড়তে থাকবেই, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, মার্কিন ডলারের মূল্য ৮৮-৯০ টাকা পর্যন্ত উঠে যাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশংকাজনক। কথা শুধু এটুকুই নয়। অর্থনীতিবদসহ বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন এবং এমন অনুমান সত্যও যে, করোনার বিপদ সহজে কাটবে না বলে ডলারের মূল্য আরো বাড়তেই থাকবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে আমদানি ও রফতানিসহ পণ্যের মূল্যের ওপর। আমদানি ব্যয় বাড়বে বলে পণ্যের মূল্যও বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে রফতানি করতে গিয়ে একই ডলারের কারণে ক্ষতির শিকার হবেন ব্যবসায়ীরা। জনগণও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া পণ্যমূল্যের কারণে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতো আমরাও মনে করি, সরকারের উচিত বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করা। অমদানি ব্যয় মেটানোর আড়ালে টাকার পাচার বন্ধ করার পাশাপাশি পরিস্থিতিতে অবশ্যই দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো দরকার। দেশের ভেতরেই করোনার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করাসহ সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা সরকারের কর্তব্য, কাউকেই যাতে বিদেশে পাড়ি জমানোর এবং অবৈধ পথে টাকা পাচার করার কথা চিন্তা না করতে হয়। আমরা প্রসঙ্গক্রমে টাকা পাচারকারীদের চিহ্নিত করার এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও দাবি জানাই। এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হলেই টাকার পাচার যেমন কমবে তেমনি কমে আসবে মার্কিন ডলারের মূল্যও। সরকারকে বুঝতে হবে, ডলারের মূল্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। সুতরাং মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির রাশ টেনে ধরতে হবে অনতিবিলম্বে।