চাঁদপুরে পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা

চাঁদপুর দিগন্ত রিপোর্ট

সোনালী আঁশখ্যাত পাটের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। পাটের সোনালী অতীত এখন কেবলই ইতিহাস। এরপরও পুরোনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন পাটচাষিরা।

চাঁদপুরে পাটের সঠিক দাম না পাওয়ায় চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষকরা। দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি আয়ের এই খাত এখন পাট সংকটে ধুঁকছে। ইতিমধ্যে কাঁচা পাটের অভাবে ৫০টি পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাড়তি দামের কারণে লাভ হওয়ার পরও পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক। আর এর পেছনে অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পাট পচানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব এবং পাটের দামে মজুদদারদের কারসাজির কারণে লোকসানের শঙ্কা। এছাড়া পাট বীজ আমদানি নির্ভর হওয়ায় প্রতি বছরই ঝুঁকিতে থাকে উৎপাদন কার্যক্রম। এর পরও চলতি মৌসুমে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পাট চাষ করে চলেছে গ্রামের সাধারণ কৃষক। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সবুজ পাটকে রূপান্তরিত করেন সোনালি বর্ণে।

এরপরও বিক্রি করতে গিয়ে পড়েন দুর্বিপাকে। চলতি মৌসুমে ৮৭ লাখ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশে সোয়া ৭ লাখ হেক্টর জমিতে এ রপ্তানিজাত কৃষি পণ্যের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি জেলায়ই ২ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে পরিচর্যা।

চাঁদপুর সদর উপজেলার নানুপুরের ঘাসিপুর এলাকার এক কৃষকের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমরা পাট চাষ করে যে পরিমান পরিশ্রম করি তা সঠিক দামে বিক্রি না করতে পারায়। এখন পাট চাষ কম করছি।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশে পাটচাষির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ হলেও এখাতের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। আর জিডিপি’তে পাটের অবদান ০.২৬% হলেও কৃষি সেক্টরে এর একক অবদান ১.১৪%। চলতি মৌসুমে দেশে সাড়ে ৭ লাখ হেক্টরে ৮৬ লাখ ১০ হাজার বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করা হলেও আবাদ হযেছে প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার হেক্টরে। ফলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তর-ডিএই’র মতে, আবাদ লক্ষ্য শতভাগ অর্জিত না হলেও বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে উৎপাদন লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন কৃষি যোদ্ধাগণ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে দেশ প্রতিবছর আয় করছে প্রায় ৯০ থেকে ১শ’ কোটি ডলার।

গত অর্থ বছর এখাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৮% বেশি। এ আয়ের সিংহভাগই এসেছে পাটসূতা থেকে। কাঁচাপাট রপ্তানিতে আয় ১ কোটি ডলার, যা মোট পাটজাত পন্যের ১৫%। পাটের বস্তা ও চট রপ্তানি করেও আয় হচ্ছে ১০ কোটি ডলারের মত। এছাড়া বিভিন্ন পাটজাত পণ্য রপ্তানিতেও আয় প্রায় ২০ কোটি ডলার।

গত দুই বছর ধরে বাজারে কাঁচা পাটের দাম বেশ ভালো যাচ্ছে। কিন্তু এরপরও পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। পাটচাষি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাট চাষে আগ্রহ কমার অন্যতম একটি কারণ পাট পচানোর জন্য পানির অভাব। এছাড়া প্রতি বছর পাটের দামের অস্বাভাবিক ওঠা-নামার কারণে অনেক সময় কৃষকদের লোকসানের কবলে পড়তে হয়। তাই কৃষকরা এখন পাটের বদলে অন্য যেকোনো দুই ফসল ফলানোর দিকে মনোযোগী হচ্ছেন।

সূত্র বলছে বাংলাদেশের পাট বীজের প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। আর এর পুরোটাই আসে ভারত থেকে। পাট খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী ভারত। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পাট মৌসুম এলেই তাদের বীজ নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয়।

এছাড়া বীজের মান নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে। সময়মতো বীজ সরবরাহ নিয়ে অধিদপ্তরের একটি বিভাগের নিয়মিত কাজ করতে হয়। বাংলাদেশ যে বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে সেই সুযোগও কম। যদিও আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।

এদিকে পাটের অস্বাভাবিক দাম ও সরবরাহ সংকটে চরম বিপাকে পড়েছে পাটকল মালিকরা।

ইতোমধ্যে পাটের অভাবে প্রায় অর্ধশত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার পথে আরও কিছু কারখানা। পাটপণ্য রপ্তানিকারকরা বলছেন, পাটে এমন অস্থিরতা চললে আগামীতে মুখ থুবড়ে পড়বে এ খাতের রপ্তানি আয়। তখন আন্তর্জাতিক বাজার চলে যাবে প্রতিবেশীদের দখলে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয় জেলা যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে চলতি মৌসুমে এক লাখ ৬৫ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় গতবছরের চেয়ে এবছর সাতক্ষীরা জেলাতে ৮৫ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ কম হয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে জেলাটিতে পাটের আবাদ হ্রাস অব্যাহত আছে। চলতি ২০২১-২২ মৌসুমে জেলায় পাটের আবাদ হয়েছে ১১ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে। যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ৬শ’ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার একশ’ বেল।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাসানুজ্জামান বলেছেন, পাটের আবাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আসছে অর্থবছরে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে এবং কৃষকদের সহয়তায় সবধরনের সহযোগিতা করা হবে।

ক্যপশন: চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নের ঘাসিপুর গ্রাম থেকে পাটের চিত্র ছবি তোলা হয়েছে।