কুরবানীর তাৎপর্য

কাশেম ছিদ্দিকী

পবিত্র ঈদুল আযহা মুসলমানদের সর্ববৃহৎ এক ঈদ উৎসবের নাম। হজ্জ্বের মৌসুমে উদযাপিত এ উৎসবকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ঈদুল আযহা। তবে এ দিনকে ইয়াওমুন নহরও বলা হয়ে থাকে। জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন, মিশর, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও জাজীরায় এটি ‘ঈদুল কাবীর’ বা বড় ঈদ নামে পরিচিত।

‘ঈদুল হুজ্জাজ’ বা হাজীদের ঈদ নামে সম্বোধন করে থাকেন বাহরাইনের লোকেরা। আর কুরবানীর ঈদ নামে সম্বোধন করে থাকেন ইরান, আফগানিস্তানসহ এ উপমহাদেশর লোকেরা।

কুরবানীকে যে যেনামেই জেনে থাকুক না কেন মূলত এটি একটি খাঁটি উপাসনাধর্মী কাজ। যা একটি খালিছ ইবাদত। কুরবানী নিছক পশু যবেহ নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর নির্দেশিত পন্থায় নির্ধারিত পশু তাঁর নামে উৎসর্গ করাই হলো কুরবানী। এজন্য রয়েছে নির্ধারিত নিয়মকানূন, আছে আল্লাহর প্রতি উৎসর্গের পরিপার্ণ একাগ্রতার বিষয়।

যার অন্যথা হলে তা আর ইবাদত হিসেবে গণ্য হয় না। আল্লাহ তাআলা যত প্রাণী মানুষের জন্য হালাল করেছেন, সব প্রাণী দ্বারা কুরবানী করা যায় না। যেসব প্রাণী দ্বারা কুরবানী করা যায় সেসবের মধ্যেও নির্ধারিত বয়স ও বৈশিষ্ট্যের শর্ত রয়েছে। এরপর যবাই করতে হবে নির্ধারিত সময়ে। তবেই তা হবে এবাদতের মধ্যে গন্য। হবে এবাদতময় কুরবানী। একটি তাকওয়াপূর্ণ কুরবানীর মাধ্যমে বান্দা লাভ করতে পারে তাঁর মালিক আল্লাহ সুবহানাহু তা’লার নৈকট্য।

কুরবানীর একটি অর্থ নৈকট্য অর্জন করা, কাছাকাছি যাওয়া। যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় তাই হল কুরবানী।
বিনা বাক্যে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যই হল কুরবানীর আসল উদ্দেশ্য। আল্লাহর নির্দেশে নিজ প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে উৎসর্গ করে তেমন একটি উদ্দেশ্যই হাসিল করতে চেয়েছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ)। মালিকের হুকুমের প্রতি এমন নির্ভেজাল আনুগত্যের কারণে তাঁর এ কুরবানীকে কবুল করে নিয়েছিলেন আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা। ইসলামের ইতিহাসে এ ঘটনা আল্লাহর আনুগত্যর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা মালিকের হুকুমের প্রতি বান্দার আনুগত্যের মানদন্ডে উন্নীত হয়েছে।

আল্লাহর সেই নৈকট্যলাভের জন্য কুরবানীর এ নিয়ম চলে আসছে আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) থেকে। তাই ইসলামে কুরবানীর গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন-সুন্নাহ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরবানী একটি ইবাদত এবং তা শাআইরে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআন ও হাদীস এ ব্যাপারে করা হয়েছে ব্যাপক গুরুত্বারোপ । মহান আল্লাহ তাঁর হাবীবকে বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’(কাওছার-২)। কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করত। তারই প্রতিবাদে এ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে একমাত্র আল্লাহর জন্যই হবে ছালাত ও কুরবানী।

অন্য এক আয়াতে ‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ-৩৬)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর আমরা তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী। আমরা এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ১০৭-১০৮)।

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্তেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’। এটি ইসলামের এমন এক ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীম’ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা.)নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং নিয়মিত আদায় করেছেন সাহাবীগনও।

এ ছাড়া মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত আদম (আ.) হতে পৃথিবীর সব জাতিই কোন না কোন পদ্ধতিতে আল্লাহর দরবারে উৎসর্গ করেছেন নিজেদের প্রিয়বস্তুু। মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন’ (সূরা আল হজ্জ-৩৪)। কুরবানীর জন্য প্রয়োজন বান্দার নির্ভেজাল আনুগত্য। তাকওয়া বিহীন কুরবানী শুধুই রক্তপাত। আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা তাঁর প্রিয় হাবিবকে বলেন,
‘আদমের দু’পুত্রের (হাবিল ও কাবিল) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনাও যখন তারা উভয়ে কুরবানী করলো তখন একজনের কুরবানী কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, ‘আমি তোমাকে হত্যা করবোই’। অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন।” (সূরা মায়িদা, আয়াত: ২৭)।
নবী-রাসুলগন ছিলেন এ আল্লাহ্ভীতি বা তাকওয়ার জীবন্ত প্রতিক। তাকওয়ার দৃষ্টান্ত যারাই এখান থেকে নিয়েছে তারাই হতে পেরেছে প্রকৃত মুত্তাকী।
কুরবানীর ক্ষেত্রে তাকওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ রেখেছেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইব্রাহীম আ.,ইসমাইল আ. এবং হাজেরা আ.। প্রতি বছর হাজীগণ মীনায় এবং দুনিয়ার সর্বত্র সমর্থবান মুসলিমগণ কুরবানী করে থাকেন তাঁদের কুরবানী বা চরম আত্মোৎসর্গের স্মৃতিকে স্মরণ করেই। ইব্রাহীম আ. তাঁর প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইলকে আ. নিজ হাতে কুরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই। মহান আত্মত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত বিরল। আল্লাহ্ পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রতি তাঁর বন্ধুর ভালবাসার ওজন।
একদিকে মালিকের নির্দেশের আনুগত্য

অপরদিকে প্রিয়তম পুত্রের প্রতি তাঁর অপরিসীম স্নেহ-মায়া-মমতা; আল্লাহপাক দেখতে চেয়েছিলেন এই দুই মধ্যে কোনটি তাঁর কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ফুটে উঠেছে কুরবানী কবুল হওয়ার জন্য মুত্তাকী বা আল্লাহ্ভীতিপূর্ণ পরিশুদ্ধ চিত্তের পয়োজনীয়তা। হাবিলের মধ্যে এটা ছিল তাই কবুল হয় তাঁর কুরবানী। কিন্তু কাবিলের মধ্যে এর অভাব ছিল বলে তার কুরবানী কবুল হয় নি। এতে সে আরো ক্ষিপ্ত হয়। হত্যা করে হাবিলকে। আল্লাহ্ভীতি না থাকলে বা কুরবানী একমাত্র আল্লাহর জন্য না হলে তা কবুল হয় না। কাবিলের নিয়তে ত্রুটি ছিল, তাই তার কুরবানী আল্লাহর দরবারে কবুল হয়নি।

ফলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে লিপ্ত হয় একটির পর একটি অন্যায় কাজে। তবে তাকওয়া শুধু কুরবানীর জন্য নয়; যেকোন ইবাদতের পূর্বশর্তও এটি। আসুন আমরা আল্লাহর নামে নিবেদন করি এক তাকওয়াপূর্ণ কুরবানী।