কঠিন সময়ের আখলাক ইসলামী দৃষ্টিকোণ

প্রফেসর ডঃ মেহমেদ গরমেজ 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
আমি আমার আলোচনার শুরুতেই সমগ্র মুসলিম উম্মাহ, বিশ্বমানবতা যে এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে সেই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য দোয়া করছি। এই কঠিন সময়েও জীবন দিয়ে যারা এই মহামারীকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই সকল ডাক্তার ভাই-বোনদেরকে, নার্সদেরকে এবং তাদের পাশাপাশি মানুষের জরুরী প্রয়োজন সমূহকে পূর্ণ করার জন্য সকল ধরণের রিস্ক নিয়ে যারা সেবাকে ইবাদত মনে করে যারা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাদেরকে এবং এই সময়ে বাসায় থেকে যে সকল মুরুব্বীকে সকলকে সাহায্য করছেন তাদেরকেও, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছি।
এই সময়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কথাকে মেনে চলা প্রয়োজন। এখন তাদের উপদেশ শুনে সেই অনুযায়ী চলা মূলত আমাদের পবিত্র দ্বীনেরও আদেশ। কারণ মহান আল্লাহ প্রদত্ত্ব আমানত জানকে রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।
এখন নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য এবং অন্যকে সংক্রমিত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য আমাদের ঘরে অবস্থান করা।
এক অর্থে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাচীরের মত দাঁড়ানোর মত, মানুষকে রক্ষায় পাহারাদারের ভূমিকা পালন করার মত।মহান আল্লাহ আমাদের সকলের জন্য এবং সমগ্র মানবতার জন্য যেন সব কিছুকে সহজ করে দেন। আজকের আলোচনায় আমি তিনটি প্রশ্নের জবাব আমার সাধ্যমত অল্প সময়ের মধ্যে দেওয়ার চেষ্টা করব। প্রথম প্রশ্ন হল, এই কঠিন সময়ে কঠিন সময়ের ঈমান, কঠিন সময়ের আখলাক বলতে কি বুঝায়?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, এই সময়ে আমরা আমাদের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক (রসসঁহব) ইমিউন সিস্টেমকে কিভাবে শিক্তশালী করব?
আমাদের সকলের উপর অর্পিত দায়িত্ব কি?
রাষ্ট্র-প্রশাসন, ব্যক্তি, পরিবার, যুবক সকলের উপর অর্পিত দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে এই সকল বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করতে চাই।
তৃতীয় প্রশ্ন হল, মানব সভ্যতা হিসেবে আমরা এই সময়কে কিভাবে রহমতে রূপান্তরিত করতে পারি? আমি জানি, আজ দারস (শিক্ষা) দেওয়ার সময় নয়, আজ দারস (শিক্ষা) নেওয়ার সময়। আজ হাহাকার করার সময় নয়, মানুষের পাশে দাড়ানো এবং সমস্যাকে দূরীভূত করার সময়। আজকে আমি যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করব আশা করি সামান্য হলেও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এবং সমস্যা সমূহকে দুরিভূত করার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। এই আশা নিয়ে আমি আপনাদের সাথে কিছু বিষয় শেয়ার করতে চাই।
প্রিয় ভাইয়েরা,মানুষের জীবনে অনেক কঠিন সময় আসে। জাতীয় জীবনেও অনেক কঠিন সময় আসে।সামাজিক জীবনেও অনেক কঠিন সময় আসে। কিন্তু বর্তমান সময়েই হয়তবা প্রথমবারের মত পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিন, ধনী, দরিদ্র কোন কিছুর মধ্যে ভেদাভেদ না করে এই কঠিন সময় এসেছে। সমগ্র মানবতা আজ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। মহা-গ্রন্থ আল কোরআন, মানুষকে নিয়ে আলোচনা করা সময় তাদের এই কঠিন সময়কে দুইটি পরিভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ সমস্যা ও কঠিন সময় যুদ্ধ-বিগ্রহ, মহামারী, খরা, বালা-মুসিবত, অসুস্থতা এই সকল কিছুর জন্য এই পরিভাষা যে সকল আয়াতে এই সকল পরিভাষা সমূহ উল্লেখিত হয়েছে সে সকল আয়াতে আমাদেরকে কঠিন সময়ের ঈমান এবং কঠিন সময়ের আখলাকের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। কঠিন সময়ের ঈমান হল অনেক আশা ভরসা নিয়ে মহান প্রভুর কাছে দোয়া করা।
মানুষকে আশার বানী দেওয়া, তাদের হৃদয়ে ভালোবাসা সৃষ্টি করা। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হল কখনোই হতাশ না হওয়া। কঠিন সময়ে যে বিষয়টি মু’মিনের সাথে একে বারেই যায় না সেটা হল হতাশ হয়ে পড়া।
মহাগ্রন্থ আল-কোরআন মানুষের দুইটি ভুলকে তুলনা মূলকভাবে উল্লেখ করে থাকে।
সেটা হল, যখন অবস্থা ভালো থাকে তখন অকৃতজ্ঞের মত আচরণ করা আর যখন অভাব-অনটন কিংবা কোন সমস্যায় পড়ে তখন আশাহত হয়ে পড়ে।এই উভয় বিষয়টিকে কোরআন একই ধরণের ভূল হিসেবে গণ্য করে থাকে। এবং মানুষের এই আচরণ কিংবা বৈশিষ্টকে নিয়ে কোরআনের অনেক স্থানে সমালোচনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা ইসরায় মু’মিনের এই বিষয়কে এইভাবে উল্লেখ করেছেনঃ
মহান আল্লাহ মানুষের এই অবস্থাকে তুলে ধরতে গিয়ে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বলেছেন,
অর্থঃ মানুষের অবস্থা হচ্ছে এই যে, যখন আমি তাকে নিয়ামত দান করি তখন সে গর্ব করে ও পিঠ ফিরিয়ে নেয় এবং যখন সামান্য বিপদের মুখোমুখি হয় তখন হতাশ হয়ে যেতে থাকে।  (সূরা বনী ইসরাইল-৮৩)
এই একই বিষয় দেখুন সূরা রুমে মহান আল্লাহ কিভাবে উল্লেখ করেছেন,
অর্থঃ যখন লোকদের দয়ার স্বাদ আস্বাদন করাই তখন তারা তাতে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। অর্থঃ এবং যখন তাদের নিজেদের কৃতকর্মের ফলে তাদের ওপর কোন বিপদ এসে পড়ে তখন সহসা তারা হতাশ হয়ে যেতে থাকে।  মানুষের আচরণ ও অবস্থাকে মহান আল্লাহ সমালোচনা করেছেন। এই একই বিষয়কে মহান আল্লাহ সূরা ফুসসিলাতে ভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন, অর্থঃ কল্যান চেয়ে দোয়া করতে মানুষ কখনো ক্লান্ত হয় না।  অর্থঃ আর যখন কোন অকল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হতাশ ও মনভাঙ্গা হয়ে যায়।  কঠিন সময়ের ঈমান বলতে আমি এই সকল বিষয়ের দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। মু’মিন যতই কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হোক না কেন, কক্ষনোই আশাহত হবে না এবং মহান রবের উপর ভরসা করে অনেক আশা নিয়ে এই সকল অবস্থাকে পরিবর্তন করার জন্য চেষ্টা করবে। একই আয়াত সমূহে একই সাথে কঠিন সমূহের আখলাক সমূহ রয়েছে। কঠিন সময়ের আখলাক হল ইহসানের আখলাক, কঠিন সময়ের আখলাক হল পরার্থপরতার আখলাক, ইনফাকের আখলাক, ক্ষমার আখলাক, ধৈর্যের আখলাক। এই সকল বিষয় একই আয়াতে উলেখিত হয়েছে। কঠিন সময়ের আখলাক হল ইহসান। ইহসান হল, সকল ধরণের খারাপ বিষয়কে ভালোর দ্বারা প্রতিহত করা, কাজকে সহজ ভাবে তুলে ধরা। এই কঠিন সময়ে কোন ভাইয়ের জীবনই যেন বিপন্ন না হয় এই জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কঠিন সময়ের আখলাক হল ‘ইসার’। ইসার কাকে বলে? সর্বাবস্থায় অন্যকে, অপর ভাইকে নিজের উপর প্রাধান্য দেওয়া, প্রতিবেশীকে নিজের উপর প্রাধান্য দেওয়া।
কঠিন সময়ের আখলাক হল ইনফাকের আখলাক। নিজের যা কিছু আছে সব কিছুকে অপর ভাইয়ের সাথে শেয়ার করা। কঠিন সময়ের আখলাক হল ক্ষমার আখলাক। সব সময় ক্ষমাশীল হওয়া, দয়াশীল হওয়া এবং গঠনকারী হওয়া। কঠিন সময়ের আখলাক হল ধৈর্যের আখলাক।
প্রিয় ভাইয়েরা, কোরআনে যে ধৈর্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার অর্থ সহ্য করা কিংবা কোন ভাবে পার করে দেওয়া নয়। কোরআনে যে ধৈর্যের কথা বলা হয়েছে তার অর্থ হল, প্রতিরোধী হওয়া; অন্যায় এবং অত্যাচার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রেরনাকে কক্ষনোই হারিয়ে না ফেলা। এই সকল বিষয়কে কোরআনে এই ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
অর্থঃ যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ –ক্রটি মাফ করে দেয়। আরএ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন। প্রিয় ভাইয়েরা, দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই সেটা হল, আমাদের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ইমিউন সিস্টেম নিয়ে। ইনশাল্লাহ মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এই কঠিন সমূহ পার হয়ে যাবে। কিন্তু এই সময়ে আমরা যে মর্যাদা ও আখলাকী আচরণ অর্জন করব তা আমাদের কাছে থেকে যাবে। এই সময়ে একটি ভাইরাসে আক্রান্ত না হওয়ার জন্য আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে (শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা) শক্তিশালী রাখা যতটা গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে জাতি হিসেবে ও উম্মাহ হিসেবে আমাদের রুহী, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করা আরও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এই কঠিন সময়ে আল্লাহ প্রদত্ত্ব জীবন নামক আমানতকে রক্ষা করা, তার সবচেয়ে বড় আদেশ সমূহের একটি। আমি আমার আলোচনার শুরুতেও এই কথা বলেছি। কিন্তু; একদিক থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করার সময় অপর দিকে আমাদের ঐক্য, একতা এবং ভ্রাতৃত্ব যেন বিনষ্ট না হয় এই জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এক দিক থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি। সকলেই আমাদেরকে এই উপদেশ দিচ্ছে। কিন্তু অপরদিক থেকে আমরা যেন আমাদের মধ্যকার বন্ধনকে শক্তিশালী করার কথা ভূলে না যাই। একদিক থেকে শারীরিক ভাবে একে একত্রিত হওয়া থেকে মাহরুম হচ্ছি, মুসাফাহা পর্যন্ত করতে পারছি না। কিন্তু এই সময়ে আমাদের মধ্যকার আন্তরিক সম্পর্ককে বাড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। একদিক থেকে আমরা ব্যক্তিগত ভাবে নিজেদেরকে কোয়ারেন্টাইনে রাখছি এবং আমাদেরকে বারংবার এই কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা আমরা অবশ্যই করব। অপর দিক থেকে সামাজিক ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বকে রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। যে সকল ভাষা আমাদেরকে মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করে ও দূরত্ব বাড়ায় সেই সকল ভাষা থেকে দূরে থাকব। সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্ত্বা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশী সতর্ক থাকতে হবে। আমরা নিকট অতীতে আমাদের জাতিকে যে বিভাজন করেছি ও নিজেরা বিভাজিত হয়েছি সেটাকে ভুলে যেতে হবে। প্রিয় ভাইয়েরা,এই মুসিবত আজ হোক কিংবা কাল হোক পার হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। কিন্তু এই সময়ে যদি আমরা কারোর মনে কষ্ট দেই তাহলে কিন্তু সেটা থেকে যাবে, খুব সহজেই সেই ক্ষত দূর হবে না। সাবধান! আসুন কারোর মনে কষ্ট না দেই। মানবতা এই ধরণের কঠিন সময় পাড়ি দেওয়ার সময় সকল প্রতিষ্ঠানের সকলের উপরে আলাদা আলাদা দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়ে থাকে। আমি পুনরায় একথা বলতে চাই যে, আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই কঠিন সময়কে পাড়ি দিতে পারব ইনশাআল্লাহ। আজকে আমরা সকলেই ঘরের মধ্যে থাকলেও আমাদের মানবিক, ইসলামী ও আখলাকী দায়িত্ব সমূহ চলমান রয়েছে। বিশেষ করে, এই কঠিন সময়ে বিত্তশালী ভাইদের উপরে অনেক বড় বড় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। প্রিয় ভাইয়েরা, এমন অনেক ভাই আছেন যারা দিন আনেন দিন খান। তারা আজ বাধ্য হয়ে ঘরের মধ্যে অবস্থান করছেন। এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ আমাদের সমাজে রয়েছে যা আমরা সকলেই জানি। আজ জমা করার দিন নয়, দান করার সকলে মিলে এক সাথে খাওয়ার দিন। আসুন আজকের এই দিনে কোরআনের এই আয়াতের উপর আমল করি আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি সেখান থেকে তারা অন্যকে দান করে। আসুন সকলেই যার যার অবস্থান থেকে দান করি। আমরা নিজের জন্য যা চাই, অপরের জন্যও তা চাওয়ার সময় আজ।
আজ আমরা এমন দিন অতিক্রম করছি যখন আমার নিজেকে নিয়ে যতটুকু চিন্তা করছি অপরকে নিয়ে ততটুকু চিন্তা করার দিন। ইনশাল্লাহ মহান আল্লাহর মেহেরবানীতে এই কঠিন সময় চলে যাবে। কিন্তু এই সময়ে যে সকল ভালো বিষয় সমূহ আমরা অর্জন করব তা আমাদের কাছে থাকবে। বিত্তশালী ভাইদের প্রতি অনুরোধ; যা আমি আমার পূর্বের দারসেও বলেছি, দয়া করা বাস্তব দোয়াকে বৃদ্ধি করুন। তারা কি করতে পারেন? ভাড়াটিয়াকে বাড়ি ভাড়া মওকুফ করে দিতে পারেন, এই কথা বলেছিলাম। তার অধীনে যারা কাজ করেন যতদূর সম্ভব তাদের বেতন দেওয়া অব্যাহত রাখুন। অতীতে যে সকল যাকাতকে দিতে পারি নাই সে সকল যাকাত দেওয়ার উপযুক্ত সময় এটা। এমনকি সামনের বছর আমরা যে যাকাত দিব তা আমরা এই বছরই দিয়ে দিতে পারি। যাকাত দেওয়ার জন্য এক বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত কিন্তু আগেও হিসাব করে দেওয়া সম্ভব বলে আমি মনে মনে করি। এই সময়ে আমাদের পারিবারিক জীবন আরও অনেক বেশী গুরুত্বের দাবীদার। বাধ্য হয়ে আমরা যে আজ আলাদা অবস্থান করছি এই সকল দিনে এবং কোরআনে কারীমেও উল্লেখিত এবং রমজানের শেষ দশ দিনে আমরা যে ইতিকাফ করি সেই ইতিকাফের চেতনাকে ধারণা করে আমাদের এই একাকিত্ত্বকে ই’তিকাফের মত বরকত ময় করে তুলতে পারি। প্যাসিফ কোন আইসোলেশন নয়, একটিভ আইসোলেশনে রূপান্তর করি। এই মুসিবত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদেরকে প্রত্যেকের উপর অর্পিত দায়িত্বকে যেন আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন সেখান থেকেই পালন করার চেষ্টা করি। এই সময়ে আমরা আমাদের ঘর-বাড়ি ও বাসাকে দু-জাহানের কামীয়াবের স্থানে রূপান্তরিত করতে পারি। এই সময়ে সব জায়গায় সুন্দর একটি শ্লোগান ভাইরাল হয়েছে, সবাই বলেছেন যে, বাসা জীবনকে ধারন করতে পারে। হা, বাসা শুধু মাত্র দুনিয়াবী জীবনকেই নয়, মূলত আখেরাতের জীবনকেও ঘর ধারন করতে পারে। উভয় জীবন যেন আমাদের বাসা ধারন করতে পারে, আসুন এই চিন্তা করি। ইন্টারনেট ও আরও অন্যান্য বৈষয়িক মাধ্যম সমূহকে ব্যবহার করে আমাদের বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, দূরে অবস্থানকারী ভাই-বোনদের খোঁজ-খবর নিয়ে এই সময়কে বরকতময় করতে পারি।আধুনিক যুগের প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আমাদের বাসা-বাড়ীকে ইলিম ও ইরফানের মক্তবে পরিণত করতে পারি। মহান আল্লাহ মুসা (আঃ) ও তার ভাইকে উদ্দেশ্য করে একটি বিষয় বলেছিলেন, তোমরা তোমাদের ঘরকে কিবলায় পরিণত কর তথা ইবাদতগাহে পরিণত করো। আপনাদের ঘরকে নামাজগাহে পরিণত করুন। এই সকল বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সময়। এই সময়ে আমার প্রিয় যুবক বন্ধুদেরকে কিছু কথা বলতে চাই।
প্রিয় যুবকরা এই সময়ে তোমাদের উপরেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব আছে। এই সময়ে নিজেদেরকে রক্ষা করার সময় মুরুব্বীদের প্রতিও খেয়াল রাখবে, তাদের সাহায্য যহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। বিশেষ করে এই দিন সমূহে যে সকল মুরুব্বীগণকে তাদের নিজেদের সু-স্বাস্থ্যের জন্য বাহিরে বের হতে হয়।তাদের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তার দিকে নজর দিতে হবে।এছাড়াও তোমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পড়াশুনা চালিয়ে যাবে। নিজেদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য বড়দের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।
প্রিয় যুবকরা, তোমরা কি জান? আমাদের সংস্কৃতিতে বয়স্ক পরিভাষাটি খুব বেশী ব্যবহার করা হয় না।ইখতিয়ার শব্দটিকে বেশী ব্যবহার করা হয়।এই শব্দটি খাইর থেকে আসে। যার অর্থ হল সমাজের মুল ব্যক্তিগণ। এর অর্থ হল সমাজের কল্যাণ। যেখানে মুরুব্বীগণ থাকেন সেখানে কল্যাণ থাকে। যেখানে মুরুব্বীগণ থাকেন সেখানে বরকত থাকে এবং শান্তি থাকে।
প্রিয় যুবকরা, শারীরিক দূরত্বকে বজায় রাখলে মুরুব্বীদের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করো।কঠিন সময়ে সমাজকে হেদায়েতের প্রতি আহবান কারী সম্মানিত আলেমদের প্রতি, আপনাদের একজন ভাই হিসেবে ও একই পেশার মানুষ হিসেবে কয়েকটি বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
প্রিয় আলেমগণ, অন্যান্য সকল বিষয়ে আমরা যেমন ভুল করে থাকি আসুন দয়া করে এই বিষয়ে একই ভুল আর না করি। যদিও এই কথা বলার আমার অধিকার নেই, তবুও আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি। এই মুসিবতকে মূল্যায়ন করার সময় তাড়াহুড়া করে যেন আমাদের কেউ এটাকে কিয়ামত, কেউ আবার দাব্বাতুল আরদ, কেউ আবার ইয়াজুজ মাজুজ, কেউ আবার ইলাহী আজাব ও গজব, কেউ আবার ধ্বংস এই ধরণের মন্তব্য না করি। দয়া করে ইলম ও হিকমাহ থেকে পৃথক হয়ে
কোরআনের ভাষায়, গায়েবে পাথর নিক্ষেপ না করি। সম্মানিত আলেমগণ, এই ধরণের বড় বড় অসুস্থতার সময়ে আমাদের দ্বীনদার দেরকে রোগের বাহন হতে যেন না দেই। খণ্ডিত একটি দুনিয়া এবং ত্রুটিপূর্ণ জ্ঞান নিয়ে আমরা যা তা যেন না বলি। আসুন কোন বিষয়কে মূল্যায়ন করার সময় সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করি। আয়াতে তাকভিনির (মহাবিশ্ব) সাথে কোরআনকে, সুন্নতকে, মানুষকে এবং আকলকে এক সাথে মূল্যায়ন করি। এই রকম সময় সমূহ, থিওরিক থিওলজি করার জন্য মোটেই উপযুক্ত সময় নয়।ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, বড় বড় বিপদ সময়ে একই সাথে ই’তিকাদকে বিনষ্টকারী বাতিল বিশ্বাস সমূহের জন্ম হয়ে থাকে। অনেক দ্বীন যাবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝে মধ্যেই এমন বিষয় সমূহ দেখি যার সাথে দ্বীনের কোন সম্পর্ক নেই। আসুন সেই সকল বিষয়কে পরিত্যাগ করি।আজকে কথার মুয়াল্লিম নয়, আশার মুয়াল্লিম হওয়ার সময়।
মুহতারাম হুজুরগণ,
আমরা সকলেই পরিক্ষার এই দুনিয়ায় শিক্ষায় পরিপূর্ণ এক বিশ্বব্যাপী সংক্রামক ব্যাধির মুখোমুখী। আমরা আলেমগণ যদি এটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে মানুষের হেদায়েতের ওসিলা হতে চাই তাহলে মানুষকে ভীতিমূলক একটি স্রষ্টার দিকে ধাবিত না করি। কেউ যেন রাহমান ও রাহীম রবকে আকাশ থেকে ক্রোধ বর্ষণকারী, আযাব প্রেরণকারী একজন ইলাহ হিসেবে তুলে না ধরি। এই অধিকার কারোর নেই। এটা আমি সুস্পষ্ট ভাবে বলতে চাই।
এটা যে সুন্নাতুল্লাহ এবং এর মধ্যে যে অনেক শিক্ষা রয়েছে সেই শিক্ষাকে অর্থহীন করে তুলবে, এমন ভাবে যেন আখেরী যামান বলে বলে মূল শিক্ষা থেকে উপকৃত হওয়া থেকে কাউকে বঞ্চিত না করি। আমাদের মহান রব এই মহা বিশ্বকে তার রহমান সিফাতের মাধ্যমে পরিচালনা করে থাকেন
তিনি নিজের জন্য রহমতকে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছেন। মহান রব একথা বলেছেন।
তিনি শুধুমাত্র তার নামাজ আদায়কারী এবং তাঁর অনুগত বান্দাদেরকেই রিজিক দেন না। যারা তার অবাধ্যতা করে তাদেরকেও তিনি রিজিক দেন লালন পালন করেন। যারা তার অবাধ্যতা করে তাদেরকে তিনি মাঝে মধ্যে আরও বেশী করে দেন। এই সকল বিষয়কে বিশ্লেষণ কিংবা মূল্যায়ন করার সময় এই সামগ্রিক বিষয়কে বিবেচনায় রাখতে হবে।
আজ যুবকদেরকে মনে অনেক প্রশ্ন, আজ মুসলমান আলেমদের উচিত হল যুবকদেরকে সেই সকল প্রশ্নের জবাব তৈরি করা। খারাপ এবং অকল্যাণের সমস্যার সাথে সম্পৃক্ত অনেক বড় বড় প্রশ্ন তাদের মনে। তাদের জন্য আমাদের জ্ঞানগর্ব মূলক জবাব প্রস্তুত করতে হবে। আজকে আমাদেরকে পরিবেষ্টনকারী এই সকল অকল্যানকে ইলাহী রহমত ও ইলাহী আদালতের সাথে সঠিক সম্পর্ক স্থাপণ করে পড়তে হবে, আর সেই আলোকেই যুবকদের সামনে তুলে ধরতে হবে। ইনশাল্লাহ সামনের কোন এক দারসে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আমার যুবক বন্ধুদের সাথে সাথে, মুসলমান আলেমদের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা হল এই করোনা পরবর্তী সময়ের দুনিয়া দ্বীনে মুবিন ইসলামকে কিভাবে প্রভাবিত করবে? মানুষের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবন এই সময়ের দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত হবে?
এই ধরণের বিষয় সমূহ নিয়ে এখন থেকেই জ্ঞানগত সংলাপের আয়োজন করতে হবে। সকলেই মিলে এই সকল প্রশ্নের সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। এবং সবশেষে, মানব জাতি হিসেবে আমরা এই সময়কে কিভাবে রহমতে পরিণত করতে পারি? মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বাকারার ২১৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, হতে পারে কোন জিনিস তোমরা অপছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। হতে পারে এমন অনেক জিনিস রয়েছে তোমরা পছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য খারাপ। প্রিয় ভাইয়েরা,হতে পারে আমরা এই দুনিয়াকে খুব বেশী ক্লান্ত করে ফেলেছি তাই তার একটু বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
সত্যি আমরা প্রকৃতিকে অনেক ক্লান্ত করে ফেলেছি, দুনিয়াকে যথেচ্ছা ব্যবহার করেছি। হয়ত প্রকৃতির দিকে আমাদেরকে নতুন করে নজর দিতে হবে। আমরা প্রকৃতির অধিকারকে কতটা নষ্ট করেছি এটা আমাদের পুনর্বিবেচনা করা দরকার ছিলো। কারণ আমাদের প্রভূ সেখানেও একটি মিযান স্থাপণ করেছেনঃ আল্লাহর স্থাপিত মিযান যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে প্রকৃতি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, মানুষ অসুস্থ হয়ে যায় এবং পানি দূষিত হয়ে পড়ে।খাদ্য মানুষকে অসুস্থ বানায় এবং ঔষধ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। আমরা সকলেই এর স্বাক্ষি হতে পারে এই মুসিবত মানুষ মূল্য ও মর্যাদা, সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং হিকমাহকে নতুন করে আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে। যেই সময় শক্তির প্রতিযোগিতা জীবনের মৌলিক একটি বৈশিষ্টে পরিণত হয়েছে, সেই সময়ে আজ এটা সকলের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে মানুষ কত সামান্য এবং তার অহংকার করা কত বড় একটি বাতুলতা।
প্রিয় ভাইয়েরা, মানুষের জন্য এই বিশ্বজগত একই সাথে নিয়ামত ও কষ্টের জায়গা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই প্রতিকূলতাকে নিয়ামতে রূপান্তরিত করার মানুষকে জন্য শক্তি এবং সম্ভাবনা দান করেছেন। ইতিহাসের গতিধারাকে পরিবর্তন করে দেওয়ার মত শক্তি ও সম্ভাবনা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানবতা ইতিহাসের অনেক মুসিবতকে আল্লাহর সাহায্য নিয়ামতের পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। এতে কন সন্দেহ নেই যে ইনশাল্লাহ জ্ঞানের মাধ্যমে, ঈমানের মাধ্যমে, দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে, তাদবিরের মাধ্যমে এবং তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে আজকের এই গ্লোবাল সংকটকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। কেউ কেউ বলে থাকে মানুষ মানুষের শত্রু, আমি এটা সঠিক মনে করি না। মানুষ মানুষের বন্ধু, এই ঘটনা আমাদেরকে তা প্রমান করবে। মানুষ মানুষের জন্য শিফা। এই ওসিলায় মানুষ যে মানুষের বন্ধু এবং শিফা এটা নতুন করে দেখতে পাব ইনশাল্লাহ। আমাদের প্রত্যাশা হল, মানবতা এই সমস্যা কাটিয়ে উঠার পরে এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে যেন অভিন্ন শত্রুর মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হয় এখন আমাদের সকলের অভিন্ন শত্রু হল ভাইরাস। এমন এক ভাইরাস যা মাইক্রোস্কোপ যন্ত্র দিয়েও দেখা যায় না। কিন্তু প্রিয় ভাইয়েরা, মূলত মানুষের অনেক অভিন্ন বা কমন শত্রু রয়েছে। আমরা আজ যে অবস্থায় পতিত হয়েছি, হয়তবা সেই অভিন্ন শত্রুকে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে পারিনি বলে। ঐ সকল শত্রু কি? যেমন শক্তি ও ক্ষমতার প্রতি আকাংখা। ওইগুলো কি? স্বার্থ পরতা।সেই অভিন্ন শত্রু কি? শোষণ, জুলুম, মূর্খতা, হিংসা ও বিদ্বেষ। মহান আল্লাহ সমগ্র মানবতা এই সংকটকে রহমতে পরিণত করার তওফিক দান করুন।আমি আমার আলোচনাকে মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) ও আদি মাতা হযরত হওয়া (আঃ)এর কোরআনের মাধ্যমে চিরন্তনতা প্রাপ্ত দোয়ার মাধ্যমে শেষ করতে চাই
হে প্রভু আমরা নিজেদের উপরে জুলুম করেছি তুমি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করো, আমাদের উপর রহম না করো তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত করো না।মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই দিন গুলো থেকে আমাদের পরিত্রান দান করে সমগ্র মানবতার অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। আমাদেরকে যেন নতুন এক দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করার তওফিক দান করেন। সকলকে সালাম জানাই। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আল্লাহ হাফেজ।