আর কত ??

     -কাশেম সিদ্দিকী
একের পর এক জালিয়াতি ও দূর্নীতির লোমহর্ষক কাহিনী বেরিয়ে আসছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। এই মহূর্তের সকল আকর্ষণ জেকেজি-রিজেন্ট, সাহেদ-সাবরিনা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজি-স্বাস্থ্যমন্ত্রী। খবরগুলোও তেমন। কেউ ১৫ হাজার ভুঁয়া রিপোর্ট তৈরীর দায়ে অভিযহক্ত তো কেউ কোভিড এর ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেদিন বললেন সাহেদকে তিনি চেনেন না, পরদিনই আমরা দেখলাম রিজেন্ট-এর সঙ্গে তার চুক্তি করার ছবি। ডা.সাবরিনা তো রঙিন ছবিসহ বলেই দিলেন কে কে তার পার্টনার। সব মিলিয়ে দুর্নীতি ও জালিয়াতি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এক তামিল অ্যাকশন চলচ্চিত্র ছাড়া কেউ কি ভাবতে পেরেছেন যে, হাসপাতালের গাড়ী পথচারীদের চাপা দিয়ে আহত করে সেই হাসপাতালের সিইউতে এনে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব? সেই ব্যক্তিই টেলিভিশনের টকশোতে এসে সবক দেন দেশ-জাতিকে ? একজন সাহেদের পিছনে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংবাদমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দল কমিশনের মোহে বছরের পর বছর যেভাবে ঘুরছে বা সাহেদ ঘুরাতে পেরেছে এতেই বুঝা যায় দুর্নীতি ও প্রতারণা কতটা সুলভ।
এই জঘন্য অপরাধে সাহেদ একা নয় তার নির্মাতা, কৌশলী, প্রজোজক পৃষ্ঠপোষকসহ আমাদের চারপাশে আরও অনেক বড় বড় সাহেদ ভিন্ন ভিন্ন নামে ও চেহারায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। জালিয়াতির মাধ্যমেই দেশে সাহেদ-সাবরিনাদের উত্থান। আমরা অবাক হয়ে যাই তখন, যখন দেখি সাহেদের মতো একজন প্রতারক রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী,সংবাদমাধ্যমসহ দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়! জালিয়াতিমূলক কর্মকাণ্ডের দায়ে যাদের কারাগারে থাকার কথা, তারাই আজ সবক দিচ্ছে দেশ ও জাতিকে! প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, সরকারের কর্তাব্যক্তি বা সংবাদমাধ্যমগুলো কি শাহেদের উত্থান সম্বন্ধে কিছুই জানত না? এর আগেও আমরা জি কে শামীম, পাপিয়া, সম্রাটসহ বেশ কয়েকজনের ব্যাপারে জেনেছি।
তারপরে কী হলো, এ বিষয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট তো দূরে থাক, ফলোআপ প্রতিবেদনও দেয়া হলো না। ডা. সাবরিনা আগে আটক হয়েছেন, বুধবার ধরা পড়েছেন সাহেদ। অপরাধীদের নিয়ে তৈরী রিপোর্টিংগুলোর দিকে খেয়াল করলেই দেখা যাবে অপরাধীর অপরাধের গুরুত্বের চেয়ে অপরাধের অভিনবত্ব নিয়ে সকল আয়োজন এবং সেইদিকে মনোযোগ নির্মাণের মধ্য দিয়ে কয়েক দিনের হৈচৈ শেষে ঘটনাটি জনদৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
ভাববার অবকাশ নেই, এটা এমনি এমনি হয়। বরং আমি বলতে চাই, দুর্নীতির কুশীলবরা ধরা পড়লে দুর্নীতির নির্মাতারা এইসব দৃশ্য তৈরি করেন জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্যই। গ্রেপ্তার যারা হয়েছেন, তাদের বিচার কতদূর হবে বলা মুশকিল। মূলত বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয় না থাকায় এই ধারার জালিয়াতদের উত্থান ঘটেছে দেশের কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত। ডা. সাবরিনা জালিয়াতি করে ১৫ হাজার রিপোর্ট দিয়েছেন। তাদের এই অন্যায়ের প্রভাব বহুমুখী।
ক্রান্তিকালীন সময়ে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে এই জালিয়াতির প্রভাব শুধু দেশ নয়, মানুষের স্বাস্থ্য ছাপিয়ে দেশের ভাবমূর্তিকে বিপন্ন করেছে পৃথিবীর কাছে। ইতোমধ্যে ইতালিসহ কয়েকটি দেশে বন্ধ হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের প্রবেশাধিকার। এই প্রবেশাধিকারের সঙ্গে মানুষের জীবিকার প্রশ্নও জড়িত। শুধুমাত্র অর্থের লোভে মানুষের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে তারা কভিডের মতো বিষয়ে ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে। কোনো সিস্টেমের কতটা অধঃপতন হলে মানুষের দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠে এ ধরনের জালিয়াতি, তা ভাবাও কষ্টসাধ্য।
অথচ দেশের গণমাধ্যম সাহেদকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একজন জনদরদী ব্যক্তি হিসেবে। সাহেদের হাসপাতালের লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও তাকে যে করোনা চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এই দার্নীতির দায় কোন ভাবেই এড়াতে পারেননা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তারা।
আমরা দেখেছি, এ ধরনের অভিযোগে বেশ কয়েকজন অপরাধীকে এর আগেও জেলে নেওয়া হয়েছে আবার বেরিয়ে গেছে কিন্তু দুর্নীতি কমেনি। কমানো সম্ভবও নয়। যে সিস্টেমের বলে তাদের উত্থান ঘটছে সেখানে হস্তক্ষেপ করা না গেলে পাপিয়া-সাহেদ-সাবরিনারা আসতেই থাকবেন। সাহেদ-সাবরিনা-আরিফ সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে কাজ করেছেন।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের সরাসরি আওতাভুক্ত। যেভাবে লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, শুধু এই অভিযোগেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজি এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ হতো যে কোনো যৌক্তিক দেশে। যখনই কেউ আটক হন দুর্নীতির অভিযোগে, তখন সংশ্নিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা এমন ভান করেন, যেন তারা কিছুই জানেন না। অথচ এগুলোর পেছনে সরকারি দলের প্রত্যক্ষ মদদ যেমনি থাকে তেমনি মন্ত্রী বা মহাপরিচালক পর্যায় থেকেও পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। ডা. সাবরিনা একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ভুয়া রিপোর্টের বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি জানতেন।
এ রকম অভিযোগের পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। সাহেদ, ডা. সাবরিনা, তার স্বামী আরিফ যদি হয় পারফরমার দুর্নীতিবাজ, তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্তাব্যক্তির নামঅ উঠে এসেছে, তারা কি তবে নেপথ্যের পরিচালক? সংবাদমাধ্যমের কথা না বললেই নয়। সাহেদের মতো এক অশিক্ষিত দুর্নীতিবাজকে বসিয়েছে নৈতিক কারবারির অবস্থানে। টকশো করেছেন চ্যানেলের পর চ্যানেলে । কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ ছবিও দেখতে পাচ্ছি আমরা। সাহেদের উত্থানের পেছনে রাজনৈতিক ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের কেউ কেউ বলা যায় বড় দাগেই দায়ী।
ডা.সাবরিনা অনৈতিক কাজ করেছেন। কিন্তু আমরা দেখছি কিছু সংবাদমাধ্যম তার সৌন্দর্য, পোশাক, ব্যক্তিগত জীবন, চরিত্র ইত্যাদি বিষয় উপস্থাপন করছে রসালোভাবে। অথচ ফোকাস করার কথা ছিল তাদের অপরাধের। তা হয়নি, হচ্ছে যা তাতে কার্যতঃ দূর্নীতি, জালিয়াতি আর প্রতারনাগুলো অবিরাম পেয়ে যাচ্ছে প্রেরনা৷। আমরা দেখতে চাই সাবরিনা ও সাহেদদের বিচার। দেখতে চাই তাদের পৃষ্ঠপোষক কারা।
দেখতে চাই তারা যাদের সাহায্যে নির্ভয়ে এ ধরনের জঘন্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করে যাচ্ছিল তাদের বিচারের আওতায় আনা হয় কিনা। যারা এসব প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দিয়েছেন, তাদেরকে দ্রুত পদচ্যুত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। সাহেদরা প্রতারক এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে যারা প্রতারণার প্রক্রিয়া তৈরিতে সাহায্য করে এবং সেই প্রক্রিয়া জিইয়ে রাখে, তারা আরও বড় প্রতারক। তারাই দুর্নীতিচক্রের পরিচালক। ফলে পুরো চক্রের বিচার হওয়া দরকার।
নিশ্চই জি কে শামীম, সম্রাট, পাপিয়া, সাহেদ ও সাবরিনাদের আগে থেকেই চিনতেন ও তাদের অপরাধগুলো জানতেন দেশের রাজনীতিক, সরকার ও সংবাদমাধ্যমের অনেকে। গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যত তথ্য আমরা পাই তা আগে থেকে জানা না থাকলে কোনভাবেই তা এত বিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সাহেদরা ক্ষমতা ও রাজনীতির সঙ্গে যেন অবিচ্ছেদ্য। একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ধ্বংস হতে থাকে, তখন সাহেদদের উত্থান অনিবার্য।
সাহেদরা তখনই কেবল বিপদে পড়ে যখন তাদেরই ভেতরের কোনো প্রতিপক্ষ তাদের অপরাধের বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে। একটি শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছিল রহস্যজনক কারনে সেটি আবার বন্ধ হয়ে গেছে। মন্ত্রী যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন কিংবা একটি প্রতিষ্ঠানের ডিজি পর্যায়ের কর্তা যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন। তবে শুদ্ধি অভিযান চালাবেন কে? স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি দায়িত্ব পালনে স্পষ্টতঃ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি জলাঞ্জলি দিয়েছেন। সাহেদরা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
সরকারের দায়িত্ব পুরো অপরাধ চক্রকে জাতির সামনে উপস্থাপন করার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং যে প্রক্রিয়ায় এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে তা চিহ্নিত ও মূলোৎপাটন করা। নয়তো দুর্নীতির নির্মাতাচক্র নতুন সাহেদ-সাবরিনা-আরিফ-শামীম-পাপিয়াদের তৈরি করে চলতেই থাকবে।