অপসংস্কৃতির বিশ্ব ভালবাসা দিবস

১৪ ফেব্রæয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বাংলাদেশেও অপসংস্কৃতির এই দিনটি পালন করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান বিশ্বে ভালোবাসা দিবসের নামে উৎপত্তি হচ্ছে নানান অপসংস্কৃতি ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড। ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা। ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন।

এ দিবসে ভালোবাসায় মাতোয়ারা থাকে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো। পার্ক, রোস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, ঢাবির চারুকলার বকুলতলা, আশুলিয়া, কুয়াকাটা এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ-সর্বত্র থাকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের তুমুল ভিড়।

ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে অনেক দম্পতিও উপস্থিত হয় প্রেমকুঞ্জগুলোতে। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এমনকি বুড়া-বুড়িরা পর্যন্ত নাচতে শুরু করে। তারা পাঁচতারা হোটেলে, পার্কে, উদ্যানে, লেকপাড়ে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসে ভালোবাসা বিলোতে, অথচ তাদের নিজেদের ঘর-সংসারে ভালোবাসা নেই!

পশ্চিমা নষ্ট সংস্কৃতি বিস্তার ও বেলেল্লাপনা উস্কে দেয়ার ভ্যালেন্টাইন ডে। যেখানে গর্ভধারিণী মায়ের সঙ্গেও সন্তানের সম্পর্ক ভঙ্গুর সেই সমাজ থেকে আমদানিকৃত এক দিনের ভালোবাসা দিবস পালনে সাম্প্রতিক বছরে আমাদের দেশেও একশ্রেণির অতি আধুনিক ও প্রগতিশীল দাবিদার মানুষের বাড়াবাড়ি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধকে অবজ্ঞা করে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য আর দিবসকেন্দ্রিক

অর্থনীতির নতুন প্রবণতায় তারা এ দিনটি অস্বাভাবিকভাবে পালন করে থাকে। কথিত এই ভালবাসা দিবস উপলক্ষে বিশেষ করে বিপথগামী যুবক-যুবতীরা পরস্পরকে উপহার বিনিময়ের আড়ালে চরিত্রবিনাশী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে।

কথিত আছে, রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের নির্দেশ উপেক্ষা করেই খৃস্টান গীর্জার পুরোহিত ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’ যুগলদের বিয়ের কাজ সম্পাদন করতেন। ঘটনা জানতে পেরে সম্রাট ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সেই কারাগারে থাকাকালে পুরোহিত এক যুবতীর প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ে।

সেই অপরাধে ২৭০ খৃস্টাব্দের ১৪ ফেব্রæয়ারি মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দিন পুরোহিত সেই যুবতীকে একটি চিরকুট লিখে যায়- যার শেষে লেখা ছিল ‘ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন’। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কারাগারে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন খৃস্ট ধর্মের একটি বিধান বিবাহ পদ্ধতি রক্ষার জন্য। অথচ তার মৃত্যুর দিনে ভালোবাসাবাসি নামে কিছু মানুষ নগ্নতা, অশ্লীলতা আর বেহায়াপনায় মেতে ওঠে।
মজার বিষয় হলো– বিশ্বের অনেক দেশই ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন করে না। সেসব দেশগুলোতে রয়েছে এই দিনটি উদযাপনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। ২০১৭ সালে পাকিস্তান ভ্যালেন্টাইনস ডে পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এছাড়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ও কাতারে আলেমরা ভালোবাসা দিবস পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পাকিস্তানের অনেক শহরে এক সময় ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন করা হলেও দেশটির বেশিরভাগে মানুষ একে অপসংস্কৃতি মনে করে।

মধ্যপ্রাচ্যের আরেক মুসলিম দেশ ইরান ২০০৮ সালে ভালোবাসা দিবস নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

ইরানের যুব সমাজকে পশ্চিমা সংস্কৃতির কু-প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশটি। এক বিবৃতিতে ইরান সরকার জানিয়েছে, হৃদয়, অর্ধ-হৃদয়ের প্রতীক, লাল গোলাপ এবং এদিন সম্পর্কিত কোনও কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ধরনের কার্যক্রমের কারণে জরিমানা, কারাদন্ড ও এর চেয়েও ভয়াবহ সাজা হতে পারে।

ভ্যালেন্টাইনস ডে সংক্রান্ত যেকোনো ধরনের কার্ড, পোস্টার ছাপানো, উপহার-সামগ্রী বিপণন, বিতরণ ও প্রদর্শনকে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৮ সালের পর থেকে ইরানে প্রকাশ্যে ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন করতে দেখা যায়নি। ২০০৯ সালে সৌদি আরবে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন কেন্দ্র করে পুলিশের পক্ষে জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতারক পুরুষদের কবল থেকে সৌদি নারীদের হেফাজত করতে তারা বদ্ধপরিকর।

এই দিনে পুরুষেরা মিথ্যা অনুভূতির আশ্রয় নিয়ে নারীদের সঙ্গে ভালোবাসার ভান করে। এটা নারীদের প্রকৃত সম্মানের জন্য ক্ষতিকর। ভালোবাসা দিবস পালনের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষার্থীরাও। ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারি দেশটির সোরাবায়া শহরে ভ্যালেন্টাইনস ডে এর বিরুদ্ধে র‌্যালি করে তারা।

ভাষাগত বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে, ইংরেজীতে ‘লাভ’, আরবিতে ‘মুহাব্বাত’ ও বাংলায় ‘ভালোবাসা’। পানাহার, দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি কর্মের মত ভালোবাসাও ইসলামের দৃষ্টিতে কখনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত আবার কখনো কঠিন নিষিদ্ধ তথা হারাম কর্ম।

পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানদেরকে ভালোবাসা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, সঙ্গী ও বন্ধুদের ভালোবাসা, সকল মুসলিম ও মানুষের পরস্পরের ভালোবাসা, সর্বোপরি মহান আল্লাহর সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসা ইসলাম নির্দেশিত কর্ম। এরূপ ভালোবাসা মানুষের মানবীয় মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করে, হৃদয়কে প্রশস্ত ও প্রশান্ত করে যা কল্যাণময় সমাজ ও সভ্যতার বিনির্মাণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।

সংঘাতময় এ পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য করার জন্য এ ভালোবাসার প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কতই না প্রয়োজন! কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের’ নামে শুধু যুবক-যুবতীদের জৈবিক ও বিবাহপূর্ব বেহায়াপনার দিকে যে উস্কে দিচ্ছে তা নয় বরং তাদের বয়সের উন্মাদনাকে পুঁজি করে, কতিপয় গোষ্ঠী তাদেরকে অশ্লীলতার পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধি হাসিল করতে চায়।